ধান খেত পাহারা দেওয়ার জন্য বন দফতর থেকে যে টং ঘরগুলি তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে এখন কেউ রাত জাগে না। সকালের পরে উঁচু ঘরগুলিতে কাজের ফাঁকে বিশ্রাম নেন শ্রমিকরা। অন্য সময় ফাঁকা পড়ে থাকে। বুনো হাতির উপদ্রবে অতিষ্ঠ লোকজন নিশ্চিত রোজগারের আশায় ধান ও সবজির চাষ ছেড়ে চা বাগান তৈরির কাজে ঝুঁকে পড়ছে। এ ভাবেই পাল্টে যেতে শুরু করেছে উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্সের গরুমারা অভয়ারণ্যের বনবস্তি এলাকার ছবি। শুধু জঙ্গলের বাইরে নয় শাল ও জারুল জঙ্গলের ভিতরে থাকা বস্তির জমিতেও শুরু হয়েছে চায়ের চাষ। যথেচ্ছ রাসায়নিক ও কীটনাশকের ব্যবহার করার অভিযোগ উঠছে। উদ্বিগ্ন বনপ্রাণ বিশেষজ্ঞ থেকে পরিবেশপ্রেমী প্রত্যেকেই সংরক্ষিত জঙ্গল এলাকার বাস্তুতন্ত্র পাল্টানোর পাশাপাশি বন্যপ্রাণ বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা করেছেন।
যদিও বনমন্ত্রী হিতেন বর্মন ওই বিষয়ে স্পষ্ট কিছু জানাতে পারেননি। তিনি বলেন, “এখানে কর্মসংস্থানের প্রশ্ন রয়েছে। তাই দেখা হচ্ছে যেন বন্যপ্রাণের কোনও সমস্যা না হয়।” পরিস্থিতি সামাল দিতে তাঁর দফতর থেকে রাসায়নিকের ব্যবহার ছেড়ে জৈব পদ্ধতিতে চাষের পরামর্শ দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। জলপাইগুড়ির ডিএফও সুমিতা ঘটক বলেন, “বস্তির বাসিন্দাদের বলছি জৈব পদ্ধতিতে চা চাষ করতে হবে। জঙ্গল এলাকায় রাসায়নিকের ব্যবহার চলবে না।” |
গরুমারা অভয়ারণ্যের বনবস্তি এলাকায় চা বাগান। —নিজস্ব চিত্র। |
ওই পরামর্শ শুনছে কে? গরুমারার উত্তর কালামাটি, কালামাটি, কাউয়া গাব, চড়াইমহল, চটুয়া, বুধুরাম, কালী পুর বনবস্তি জুড়ে সকাল থাকে পাতা তোলার পাশাপাশি স্প্রে মেশিন নিয়ে চলছে কীটনাশক ছড়ানোর কাজ। কড়া গন্ধে জঙ্গলের বাতাস ভারী। কালামাটি জঙ্গলের অনেকটা ভিতরে সেখানে ৭৫টি পরিবার রয়েছে। সরকারের তরফে পরিবার পিছু ৬ বিঘা জমির পাট্টা দেওয়া হয়েছে। প্রায় পুরোটাই চা বাগানের দখলে চলে গিয়েছে। একই ছবি চড়াইমহল ও চটুয়া বনবস্তির।
ধান রক্ষার জন্য ব্যাটারি চালিত বৈদ্যুতিক তারে ঘেরা এলাকায় ছোট ছোট চা বাগান গড়ে উঠেছে। সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে টং ঘর। এক বন কর্তা জানান, যতদিন বনবস্তিবাসীদের জমির পাট্টা ছিল না ততদিন সেখানে কী চাষ হবে না হবে সেই বিষয়ে সরাসরি নাক গলানো সম্ভব হয়েছে। ওঁরা কথা শুনেছেন। পাট্টা পাওয়ার পরে এখন নিজেদের মতো করে সব কিছু করার চেষ্টা করছেন। বনবস্তির কত একর জমিতে বাগান গড়ে উঠেছে সে হিসেব বন দফতরে নেই। কালামাটি বস্তির বাসিন্দা ফাগু ওঁরাও আনুমানিক হিসেব দিয়ে জানিয়েছেন কালামাটি, কাউয়াগাব, চড়াইমহল এলাকায় ৩০০ বিঘা জমিতে চা বাগান গড়ে উঠেছে।
বাসিন্দাদের প্রত্যেকে যে নিজেরা বাগান তৈরি করছেন তা নয়। নন্দু ওঁরাও, বিশ্বনাথ ওঁরাও জানান, বাইরে থেকে গিয়ে অনেকে জমি লিজে নিয়ে বাগান তৈরি করেছেন। কালামাটির বুধুয়া ওঁরাও চার বিঘা জমি লিজে দিয়েছেন। এক দিকে তিনি যেমন লিজের টাকা পেয়েছেন। অন্য দিকে নিজের জমিতে শ্রমিকের কাজ করে রোজগার করছেন। কেন চা বাগান তৈরি করলেন? বিশ্বনাথ জানান, ৫ বিঘা জমিতে ধান চাষ করে ঘরে ১০ কেজি ধান ওঠে না। ময়ূর, বাঁদর, হাতি খেয়ে সাবাড় করে। পরিশ্রমটাই সার। এ ছাড়াও ধান ও সবজির লোভে হাতির উপদ্রব লেগেই থাকে। ঘরদোর ভেঙে শেষ করে দেয়। তাই নিরুপায় হয়ে চা চাষ করছি।’’ নন্দু বলেন, “চা হাতি, ময়ূর, বাদর খায় না। তাই সমস্যা নেই। এখন ৯ টাকা কেজি পাতা বিক্রি করে রোজগার ভাল হচ্ছে।”
কিন্তু বস্তির বাসিন্দারা চা বাগান গড়ে স্থায়ী রোজগারের পাশাপাশি হাতির উপদ্রব এড়ানোর কথা ভাবলেও বিশেষজ্ঞরা উল্টো আশঙ্কা করছেন। তাঁরা জানান, সাময়িক ভাবে অভাব হয়ত মিটবে। কিন্তু পরিচিত এলাকায় খাবার না পেয়ে হাতি বেশি মারমুখি হবে। সেই সঙ্গেই চা বাগান থাকায় বাড়বে চিতাবাঘের উপদ্রব। শুধু তাই নয় হাতি, বাইসন, হরিণের মতো প্রাণিদের রাসায়নিকের সংস্পর্শে এসে বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
যেমন, অবসরপ্রাপ্ত বনাধিকারিক তথা হাতি বিশেষজ্ঞ সম্পদ সিংহ বিস্ত বলেন, “বনবস্তিতে চা বাগান গড়ে উঠলে সংরক্ষিত জঙ্গলের বাস্তুতন্ত্র বিপন্ন হবে। সবচেয়ে বিপদে পড়বে হাতি। বিভিন্ন রাসায়নিকে সংস্পর্শে এসে জটিল রোগের শিকার হবে।” এ আশঙ্কা পরিবেশপ্রেমীদের হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশন -এর মুখপাত্র অনিমেষ বসুর। তিনি বলেন, “বিকল্প চাষ বলতে জঙ্গল এলাকায় এমন কিছু চাষ করা উচিত নয় যা বন্য প্রাণের অস্তিত্বের সঙ্কট তৈরি করবে। ওই চা বাগানগুলি তো জৈব সারের উপরে নির্ভরশীল নয়। রাসায়নিক বিষ ও ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে পাখি, পতঙ্গ শেষ হবে।” |