জঙ্গলমহলের জয়পুরে এখন চলছে এক অন্য তল্লাশি। মুন্নির খোঁজে। গ্রামে গ্রামে, হাটে-বাজারে যাচ্ছেন পুলিশকর্মীরা। কখনও খাকি পোশাকে, কখনও খদ্দের সেজে। পাচারকারীর অভাব নেই, চোরাকারবারিও কম নেই এ অঞ্চলে। তাই ডালে ডালে, পাতায় পাতায়, খোঁজ চলছে। এর আগেও দু’বার পালিয়েছিল মুন্নি, প্রতিবারই পুলিশি তৎপরতায় তাকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। শুধু এ বারই ...
দশ দিন পেরিয়েও অবশ্য হাল ছাড়েননি পুরুলিয়ার জঙ্গলমহলের জয়পুর থানার আইসি অরুণ বাগদি। তদন্তে গিয়ে নিজে গ্রামবাসীদের শুধোচ্ছেন, “একটা টিয়া পাখি দেখেছেন। গায়ের রং গাঢ় সবুজ, গলার নীচের রং হালকা সবুজ। খিদে পেলে খুব চিৎকার করে।...” হদিস মেলেনি। দুষ্টু লোকেরা মুন্নিকে ধরেনি তো মনে এ দুর্ভাবনাও এসেছে। অরুণবাবু নিজের সোর্সদের এলাকার চোর-ডাকাতদের উপর নজর রাখার সঙ্গে মুন্নির খোঁজও করতে বলেছেন। সোর্সদের খদ্দের সাজিয়ে এলাকার চোরাই পাখি-কারবারিদের কাছেও পাঠিয়েছেন। লাভ হয়নি।
মুন্নির সঙ্গে তো এক-আধ দিন নয়, কমবেশি সাড়ে তিন বছরের সম্পর্ক। গিন্নি ইলাদেবীও যত্নআত্তি করে বড় করছিলেন। সেই মুন্নি নিরুদ্দেশ! কেবল পুলিশে ভরসা না করে ইলাদেবী নিজেই জয়পুর ও বড়টাঁড়ের পশুহাটে খোঁজ করেছেন। কেউ পাখি পেলে নতুন খাঁচা কিনতে পারে, সে সম্ভাবনা মাথায় রেখে পাকা গোয়েন্দার মতো খোঁজ নিয়েছেন এলাকার খাঁচার দোকানেও। কোনও ক্লু পাওয়া যায়নি। |
অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য |
জয়পুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি শঙ্করনারায়ণ সিংহ দেও জানান, তিনিও কর্মীদের পাখিটার খবর পেলে জানাতে বলেছেন। জেলা পুলিশের ডিএসপি পিনাকী দত্তের কথায়, “পাখির হদিস পেতে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নেওয়া হয়েছে বলে শুনেছি। তবে, পাওয়া যায়নি।”
ভোটের কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও তাই অরুণবাবু মুন্নির কথা ভাবছেন। জয়পুরের আগে তিনি কোটশিলা থানায় কর্মরত ছিলেন। এক শীতের সকালে কোয়ার্টার থেকে থানায় যাচ্ছিলেন। জামগাছের ডাল থেকে ঠিক পায়ের সামনে এসে পড়ল পাখিটা। “পাখিটা কাঁপছিল, জানেন! ওকে কোয়ার্টারের ভিতরে নিয়ে গেলাম। তখন থেকেই ও আমার কাছে। বড় প্রিয় হয়ে উঠেছিল। মুন্নি বলেই ডাকতাম। কখনও সখনও আদর করে মিঠু।”আক্ষেপ দুঁদে পুলিশ অফিসারের। মুন্নি ইলাদেবীর সঙ্গেই থাকত বেশি। “একবার নলহাটিতে আমার বাপের বাড়ি থেকে আর একবার পুরুলিয়ার পুলিশ আবাসন থেকে, দু’বার পালালেও পাশের বাড়িতেই পেয়েছিলাম।”বললেন ইলাদেবী। জানালেন, তাঁর ছেলে মুন্নির ডানা কাটতে দেয়নি। বলেছিল, যদি মানুষের হাত কেটে দেওয়া হয়!
সেই মুন্নিই একদিন উড়ে গেল। জয়পুর থানার এক পুলিশকর্মীর কথায়, “এ তো হওয়ারই ছিল। কিন্তু স্যারের ভারি দুঃখ। ”
স্থানীয় আমটাঁড়ের বাসিন্দা রোহিত কুমার, চকবাজারের স্বপন দাস বলেন, “আইসি সাহেবের স্ত্রী আর ছেলে এসে জানতে চাইলেন, কেউ পাখিটাকে দেখেছি কি না।” ইলাদেবীর কথায়, “লোকজন এখন আমাকে দেখলে উল্টে প্রশ্ন করছেন, পাখি পেলেন নাকি?” হতাশা ক্রমেই গ্রাস করছে অরুণবাবুকে। বলছেন, “জঙ্গলের পাখি বোধহয় জঙ্গলেই ফিরেছে।”
সব টিয়া তো একই রকম। পেলেও চিনবেন কী করে? অরুণবাবুর পাল্টা প্রশ্ন, “মুন্নিকে কি ভোলা যায়?” |