পঞ্চায়েত ভোটে এক গৃহবধূর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার দিনটি কাছ থেকে দেখলেন
অনল আবেদিন |
ভোরের আলো তখনও ঠিক মতো ফোটেনি। প্রতিদিনের থেকে একটু আগেই তাঁকে এ দিন বিছানা ছাড়তে হয়েছে। নিত্যদিনের গৃহস্থালির কাজের গতি আজ অনেকটা বেশি। কারণ, সংসারের কাজ সেরে দুই শিশু সন্তানের মাকে বেলা ১১টার মধ্যে পৌঁছতে হবে সাত কিলোমিটার দূরে, বহরমপুর বি ডি ও অফিসে। মনোনয়নপত্র জমা দিতে। মেশিনের গতিতে তিনি গোবরজল দিয়ে টালির চালা দেওয়া এক কামরা ঘরের দাওয়া নিকিয়ে, উঠোন ঝাঁট দিয়েই ছুটলেন গোয়ালঘরের দিকে। সেখান থেকে পাঁচটি গরু নিয়ে দুটি নাদার পাশের খুঁটিতে বাঁধলেন। তার পর নাদায় জাবনা ঢেলে দিলেন হরিদাসমাটি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রার্থী শিপ্রা ঘোষ। পড়িমরি করে রাতের বাসি বাসন ধুতে ছুটলেন কলতলায়।
ভোট কেবল বড় নেতাদের নয়। গ্রামে গ্রামে ভোট এমন অগণিত মেয়েকে হেঁশেল থেকে, খেত-খাদান থেকে নিয়ে আসছে গণতন্ত্রের দৈনন্দিন চর্চায়। গ্রামের মানুষের কাছে শিপ্রা ঘোষের মতো মুখচোরা বধূরাই হয়ে উঠছেন রাষ্ট্রের মুখ। |
বাসন মেজে স্বামী-সন্তানদের নিয়ে চা-মুড়ি খেয়েই ছোটছেলে মনোজিতকে স্কুলের জন্য তৈরি করায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন শিপ্রা। তার মধ্যেই বড় ছেলেকে বললেন, “দেবাশিস আজ তোর স্কুলে যাওয়া হবে না। মাঠে মুনিশ আছে। তাদের খাবার নিয়ে মাঠে যাবি। কাজ কেমন করছে দেখবি।’’ মাঠ বলতে বিঘা দেড়েক জমি। স্বামীর দশ কাঠা। বাকি জমির তাঁরা ভাগচাষি।
স্বামীর সাইকেলের রডে ছোট ছেলেকে তুলে দিয়েই শিপ্রা বাড়ির এক প্রান্তে থাকা খাঁচার দিকে ছুটলেন। ঝাপ খুলতে নিমেষে হাওয়া হয়ে গেল তিনটি মুরগি ও একটি হাঁস। ডালিতে করে সবুজ ঘাসের জাবনা নিয়ে গিয়ে গরুর নাদা আবার ভরে দিলেন। উঠোনের এক প্রান্তে জিয়োল গাছের তলায় ঝুপড়ি রান্নাঘর। দ্রুত সারলেন আলু-পটল, ডাল-ভাত রান্না।
ফিরে এসে দাওয়ায় পাটির উপর ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, মাধ্যমিকের অ্যাডমিট কার্ড, পাসপোর্ট সাইজের ছবি নিয়ে বসেছেন তাঁর স্বামী বিজয়। রান্নার এক ফাঁকে শিপ্রাদেবী দাওয়ায় গিয়ে মিলিয়ে নিয়েছেন মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার প্রয়োজনীয় নথিপত্র। স্নান সেরে ফাইল বগলদাবা করে উঠে বসলেন স্বামীর সাইকেলের রডে। ১১টা নাগাদ বি ডি ও অফিস। সেখান দলীয় প্রার্থীদের সাহায্য করার জন্য অপেক্ষা করছিলেন হরিদাসমাটি পঞ্চায়েতের উপপ্রধান বাবলু শর্মা। চার পাতার মনোনয়নপত্র তিনিই পূরণ করে দিলেন। শিপ্রাদেবী কেবল সই করলেন।
ভোটে দাঁড়াতে প্রার্থী সরকারকে দেন দেড়শো টাকা। ভোটার কার্ড দেখিয়ে রসিদ কেটে শিপ্রাদেবী সোজা ঢুকে গেলেন মনোনয়নপত্র জমা নেওয়ার টেবিলে। সঙ্গে গেলেন দুই প্রতিবেশী প্রস্তাবক বাসুদেব মণ্ডল ও সমর্থক রামকৃষ্ণ মণ্ডল। বাড়ি ফিরলেন বেলা চারটেয়। দুপুরের খাবার খেতে বিকেল চারটে। মুখে দু’মুঠো গুঁজে দিয়েই বসলেন বেলুন-পিড়ে নিয়ে। রাতের রুটি আর আলুর তরকারি করার পর গোধূলি বেলায় ঘোষ পরিবারের ঘরনি জিরোনোর জন্য একটু সময় পেলেন। তিনি বলেন, “সন্ধ্যা ৭টা থেকে ছোট ছেলেকে পড়াতে হয় আমাকে।”
দশভূজার কাজ সামলাতে হচ্ছে দ্বিভূজাকে। তার পরও ভোটে দাঁড়ানোর ঝক্কি ঝামেলা মেনে নিলেন কেন? জবাব, “আমি মাধ্যমিক পাশ। তাই পাড়ার লোকজন ও দলের নেতারা আমাকেই বাছলেন। মহিলা সংরক্ষিত আসনে কোনও মহিলাকেই তো ভোটে দাঁড়াতে হবে। তাই রাজি হয়ে গেলাম।” গৃহস্থালি ও রাজনীতি এক সঙ্গে সামলাবেন কী ভাবে? তিনি বলেন, “একান্নবর্তী পরিবার না হলেও শাশুড়ি ও আমাদের তিন জায়ের উঠোন কিন্তু একটিই। সবাই অসুখ-বিসুখে, বিপদে-আপদে পরস্পরের সহযোগিতা করি। তাই খুব একটা অসুবিধা হবে না।” |