প্রবন্ধ ২ ...
রোগটা কী, বক্তারা জেনেই গিয়েছেন
ত ক’দিনে গোটা কয়েক টিভি চ্যানেলে বার বার বলা হল, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিয়েছে। এমনকী বিশেষজ্ঞদের প্যানেল তৈরি করে এ বিষয়ে প্রশ্ন-উত্তরও দেখা গেল। আরও চমকিত হতে হল যখন এক বিরোধী নেতা টিভি চ্যানেলে মুখ্যমন্ত্রীর রোগ কী, তা নির্ণয়ও করে ফেললেন। বললেন, ‘স্কিৎসোফ্রেনিয়া।’ কী করে হল এই নির্ণয়? ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করা তথ্য হাতে নিয়ে ওই নেতা মুখ্যমন্ত্রীর নানা কথা, যা তাঁর অসংলগ্ন বা অবাস্তব মনে হয়েছে, সেগুলি উল্লেখ করে ওই রোগের একটি একটি লক্ষণের সঙ্গে মেলালেন। এর আগেও অন্য এক বিরোধী দলের নেতা মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে বলেছেন, ‘হার্মাদ গিয়ে উন্মাদ এসেছে।’
মানসিক রোগের এই রাজনৈতিক প্রয়োগ কিন্তু নতুন নয়। কোনও ব্যক্তিকে, তার বক্তব্যকে, তার রাজনীতিকে বাতিল করে দিতে ‘উন্মাদ’ কথাটার ব্যবহার নানা সময়ে নানা দেশে দেখা গিয়েছে। আমরা এমন ব্যবহার দেখেছি কমিউনিস্ট রাশিয়াতে। তখন ‘স্লো স্কিৎসোফ্রেনিয়া’ বা ‘স্লাগিশ স্কিৎসোফ্রেনিয়া’ লেবেল সেঁটে দেওয়া হত ক্রেমলিন-বিরোধী যে কোনও মুখের উপরে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে এই ‘রোগীদের’ চিকিৎসার জন্য জোর করে ধরে এনে বন্দিদশায় রাখা হত। মানসিক রোগ সে দিক থেকে রাজনীতির হাতে একটা বড় অস্ত্র, কারণ বিরোধীকে চোখের সামনে থেকে একেবারে সরিয়ে দেওয়ার এমন ভাল উপায় আর নেই।
মুখ্যমন্ত্রীর মানসিক স্বাস্থ্যে সত্যিই কোনও সমস্যা দেখা দিয়েছে কি না, মানসিক চাপ (স্ট্রেস) কিংবা অকারণ আতঙ্ক (প্যারানইয়া) তাঁকে বেসামাল করে তুলছে কি না, এ প্রশ্নগুলো কেউ তুলতেই পারেন। তাঁকে মেরে ফেলার চক্রান্ত চলছে, এটা তাঁর অতিরিক্ত ভয়ের প্রকাশ নাকি রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি, সে বিতর্কও অযৌক্তিক নয়। ঘরোয়া আলাপে এই কথাগুলো অনেকে বলেও থাকেন। কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা যখন প্রকাশ্য সভায় ডায়াগনসিস করতে বসেন, তখন আপত্তি করতে হয় তাঁদের উদ্দেশ্য নিয়ে। তাঁরা এখানে একটা রোগকে ব্যবহার করছেন এক জন মানুষকে একেবারে বাতিল, বর্জ্যের দলে ফেলে দিতে। যেন, কোনও ব্যক্তি ‘স্কিৎসোফ্রেনিক’ ছাপ দিয়ে দিতে পারলে তিনি ‘দাগী’ হয়ে গেলেন। এর পর তাঁর কোনও কথা, কাজ, কৃতিত্ব, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, কোনও কিছুরই কোনও মূল্য নেই। মানুষটাই বাতিল।
এটা কেবল দলীয় রাজনীতি নয়। এই ‘রাজনীতি’ কাজ করে প্রতিটি মানসিক রোগীর বিরুদ্ধে। তার রোগটা কেবল তার স্বাস্থ্যের সমস্যা নয়, সেটা তার ‘অক্ষমতা’ বলে দেখা হয়। কেবল তার পারা না-পারার পরিধি নয়, সে মানুষ কি না, তাই নিয়েই প্রশ্ন তোলা হয়। ‘পাগল’ হয়ে গেলে সে আর ‘মানুষ’ নয়, এমন চিন্তার অভ্যাস কিন্তু কেবল সাধারণ মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। আইনও মনে করে, এদের চেক সই করার ক্ষমতা নেই, নিজের সম্পর্কে কোনও সিদ্ধান্ত এরা নিতে পারে না। এই মনোরোগের রাজনীতির শিকার মেয়েদের আরও বেশি হতে হয়। এদের অনুমতির তোয়াক্কা না করেই এদের গর্ভাশয় বাদ দেওয়া যায়, গর্ভপাত করানো যায়, সদ্যোজাত শিশুকে কেড়ে নেওয়া যায় মায়ের থেকে। জামা-কাপড় কেড়ে নিয়ে উলঙ্গ করে রাখাও যায়। সে কখনও ভাল হয়ে উঠতে পারে, সেই সম্ভাবনা বাতিল করে দিতে কারও গলা কাঁপে না।
স্বাস্থ্যের অন্য সমস্যার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বা পুলিশ রোগনির্ণয়ে বা চিকিৎসার পদ্ধতিতে নাক গলায় না। আন্ত্রিক বা টাইফয়েড পুলিশ ধরতে পারে না, পেটের আলসার ধরার কাজ জজ সায়েবের নয়। শুধু মনোরোগের ক্ষেত্রেই পড়শি থেকে পুলিশ, আত্মীয় থেকে আদালত, সবাই লেগে যায় কাউকে রোগী বলে চিহ্নিত করে তাকে পাগলাগারদে পোরার মহান কর্তব্যটি পালন করতে। যেন মনোরোগীর দিকে যে-কেউ এক ঝলক দেখেই বলে দিতে পারেন, এ-ই রোগী।
কেন এমন সর্বনেশে তাগিদ মনোরোগীকে চিহ্নিত করার? তার কারণ আমরা ধরে নিয়েছি, মনোরোগী তার আশেপাশের মানুষের কাছে একটা মস্ত ঝুঁকি। ‘পাগল’ যা ইচ্ছে করতে পারে। ভয়ঙ্কর খুন-ধর্ষণ ঘটলেই আমরা ধরে নিই, এ পাগলের কাজ। মনোরোগীর এই ভয়ঙ্করত্ব আদতে সামাজিক নির্মাণ। মনোরোগীদের খুব কম অংশই অন্যের প্রতি হিংসাত্মক হয়ে ওঠেন। বরং মনোরোগীরাই অন্যের হিংসার শিকার হন। বহু সমীক্ষায় এই তথ্য উঠে এসেছে।
রাজনীতিতে, সমাজে কিংবা পরিবারে, কোনও ব্যক্তি মনোরোগের কারণে অন্যদের বিপন্ন করছে, এই ধারণা ছড়ানো সামাজিক অপরাধ। কোনও রাজনৈতিক নেতা যদি সত্যিই মনে করেন যে কারও মনোরোগ হয়েছে, তবে তিনি কি সেই ব্যক্তিকে অক্ষম প্রতিপন্ন করতে, তাঁকে পরিহাস করতে, তাঁর রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিপন্ন করবেন? নাকি রোগের সুযোগ নিয়ে কেউ যাতে সেই ব্যক্তিকে বিপন্ন করে তুলতে না পারে, সেই উদ্দেশ্যে নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন? মুখ্যমন্ত্রী মনোরোগী কি না, সে প্রশ্নের চাইতে ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এই প্রশ্নগুলি। মনোরোগী চিহ্নিত না করে রাজনৈতিক নেতাদের যা করা উচিত, তা হলে মনোরোগীদের মূলস্রোতে ফেরানোর চেষ্টা।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.