|
|
|
|
প্রবন্ধ ১ ... |
আপনার জন্য আর কোনও আড়াল নেই |
ব্যক্তিস্বাধীনতার সমস্ত রক্ষাকবচ হারিয়ে নিরাপত্তারক্ষীদের রক্তচক্ষুর সামনে দুনিয়ার তাবৎ মানুষ আজ নগ্ন।
যে নজরদারির জাল বোনা হয়েছে দুনিয়া জুড়ে, সেটাই ফাঁস করে দিয়েছেন এডওয়ার্ড স্নোডেন।
সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় |
‘‘পৃ ১ আইটেম নং ১। লাল পিঁপড়ের গর্তে খোঁচা দিয়ে, তার মধ্যে একটি জীবন্ত কেঁচো নিক্ষেপ ও তার বিস্তৃত বিবরণ তাং ১৯।৬।৩৯।
বিজন মূক হয়ে গেল। সে এইবার টের পেল কী ভয়াবহ ও ব্যাপক এদের অনুসন্ধান। সে বলতে চাইল, ‘এ ত আমার ছেলেবেলার ঘটনা। এ আপনারা জানলেন কী করে?’’
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, বিজনের রক্তমাংস |
এই লেখা তৈরি করার সময় পর্যন্ত এডওয়ার্ড স্নোডেন ফেরার, মস্কো থেকে হাভানাগামী বিমানে তাঁকে দেখা যাবে-যাবে করেও দেখা যায়নি, মার্কিন প্রশাসন অপরাধী ঘোষণা করে তাঁর পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করেছে, চিনকে ভর্ৎসনা এবং রাশিয়াকে প্রবল কূটনৈতিক চাপ দিচ্ছে। অন্য দিকে মুক্ত-ইন্টারনেটপন্থীরা অভিনন্দনে ভাসিয়ে দিচ্ছে স্নোডেনকে। ১৯৭১-এ শতাধিক বছরের কারাদণ্ডের ঝুঁকি অগ্রাহ্য করে ‘পেন্টাগন পেপার্স’ ফাঁস করেছিলেন ড্যানিয়েল এল্সবার্গ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষ হওয়ার পিছনে যা বড় ভূমিকা নেয়। সেই এল্সবার্গ এখন স্নোডেনকে ‘দেশপ্রেমিক’, ‘সাহসী সৈনিক’, ‘আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্দা-ফাঁসের নায়ক’ এই সব বলে অকাতরে সার্টিফিকেট দিচ্ছেন। ইকোয়েডরের দূতাবাসে স্বেচ্ছাসেবী উইকিলিক্স-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ‘নায়ক’ আখ্যা দিচ্ছেন তাঁকে। বোঝাই যাচ্ছে যে, স্নোডেন যা ফাঁস করেছেন, তা নিছক কিছু ই-মেল বা ফোন-ট্যাপের ঘটনার সঙ্গে তুলনীয় নয়। স্নোডেনের দাবিগুলি যদি সত্য হয় (যার আংশিক সত্যতা মার্কিন প্রশাসন স্বীকার করেছে), তা হলে প্রিজ্ম হল, বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নজরদারির প্রোজেক্ট, যা হেলায় গুনে গুনে দশ গোল দেবে গেস্টাপো-কেজিবি-এম আই ফাইভ-এর সম্মিলিত টিমকে।
এমনিতে আমেরিকায় ব্যক্তির উপর নজরদারি এবং তার ডকুমেন্টেশন কোনও নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে তার চরিত্রে একাধিক বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে। তথ্য হয়ে উঠেছে আকার ও ক্ষমতায় দৈত্যাকৃতি। প্রথমত, প্রযুক্তির কারণে তথ্যের পরিমাণ অকল্পনীয় রকম বেড়ে গেছে। প্রয়োজন থাক বা না থাক, প্রতিনিয়ত রেকর্ড করা হচ্ছে মানুষের ‘স্বভাব’, ‘চরিত্র’, ‘স্বাস্থ্য’ ইত্যাদির হিসেবনিকেশ। ‘ক্রেডিট হিস্ট্রি’ অর্থাৎ ধার নেওয়ার ইতিহাস দিয়ে মেপে রাখা হচ্ছে ব্যয়ের অভ্যেস ও তার প্যাটার্ন। এর পর আছে ড্রাইভিং রেকর্ড, ক্রিমিনাল রেকর্ড, মেডিক্যাল হিস্ট্রি। এবং তা ছাড়াও জমিয়ে রাখা হচ্ছে আরও অজস্র আপাতদৃষ্টিতে অদরকারি তথ্যসমূহকে।
দ্বিতীয়ত, তথ্যের বিশ্লেষণে এসেছে আমূল পরিবর্তন। নজরদারি করে পাওয়া বিপুল তথ্য বিশ্লেষণ করার জন্য দরকার নতুন কায়দা। তাই জনচক্ষুর প্রায় আড়ালে একবিংশ শতাব্দী পুনর্জন্ম দিয়েছে বিশেষ কয়েকটি ডিসিপ্লিনের, তার একটির নাম ডেটা অ্যানালিটিক্স। মানুষ সম্পর্কে যে পরিমাণ তথ্য জমা করা হচ্ছে, তার বেশির ভাগ অংশটাই মানুষ নিজেই জানে না। যেমন গর্ভবতী মহিলাদের প্রথম তিন মাসে কেনাকাটা করার নাকি নির্দিষ্ট একটি প্যাটার্ন থাকে। ডেটা অ্যানালিটিক্স খুঁজে বার করেছে সেই প্যাটার্নকে, যা মহিলারা নিজেরাই জানেন না। ২০১২ সালের এক রিপোর্ট জানিয়েছিল যে, একটি আমেরিকান রিটেল চেন, স্রেফ তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করেই জেনে ফেলছে, তাদের মহিলা খদ্দেরদের মধ্যে কারা গর্ভবতী এবং সেই অনুযায়ী তাঁদের পাঠানো হচ্ছে কেনাকাটার কুপন।
তৃতীয়ত, সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটি এসেছে তথ্যের ব্যবহারে। আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য যেমন আবহাওয়ার পূর্বাভাসের কাজে লাগানো হয়, তেমনই ব্যক্তি সংক্রান্ত তথ্যকে কাজে লাগানো হচ্ছে তার ভবিষ্যৎ আচরণবিধি নির্ধারণের জন্য। |
|
ওয়েব দুনিয়ার দৈত্য গুগলের তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি তো সর্বত্র আলোচিত এবং বিতর্কিত। বিপুল তথ্যভাণ্ডারের ওপর ভরসা করেই, এরও আগে ২০০৭ সালে, গুগলের দূরপাল্লার লক্ষ্য কী, সেটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে চিফ এগজিকিউটিভ এরিক স্মিট বলেছিলেন, এমন এক দিন আসবে যখন মানুষ আর শুধু ইন্টারনেট থেকে পড়া, দেখা বা জানার বস্তু খুঁজে বার করার জন্য সার্চ করবে না, বরং আরও কিছু ‘অতি-ব্যক্তিগত’ প্রশ্নের উত্তর খুঁজবে। বাবরের সমাধি কোথায়, এ বছর বিশ্বের সবচেয়ে ধনী মানুষ কে, বা মানুষের অ্যাপেন্ডিক্স কোথায় থাকে এই জাতীয় প্রশ্ন ছাড়াও, এমন দিন আসবে, যখন ‘আমি কাল কী করব’ বা ‘কোন কলেজে আমার পড়া উচিত’ এই জাতীয় একান্ত ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তরও মানুষ ইন্টারনেটের সার্চ ইঞ্জিনের কাছ থেকে জানতে চাইবে। স্মিট আজ থেকে ছ’বছর আগে, তাঁদের আকৃতি ও প্রকৃতিতে দৈত্যাকার তথ্যভাণ্ডারের ভরসায় জানিয়েছিলেন, দূরপাল্লায়, গুগল এই সব একান্ত ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেওয়ার চ্যালেঞ্জটি নিতে ইচ্ছুক।
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন প্রোজেক্টের গোড়ার দিকের মতোই, এ সবই ছিল তথ্য নিয়ে খেলাধুলো। আপনি প্রেমিকার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের সময় কী কী শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেছেন, বা মোবাইলে কলার টিউন বদলেছেন ঠিক কোন দিন, ডান দিকে ফিরে শুলে আপনার কোমরে ব্যথা হয় কি না এ সব অদরকারি তথ্য, নেহাতই ‘কখনও যদি কোনও কাজে লাগে’ ভেবে জমিয়ে রাখা হচ্ছিল খেলাচ্ছলে। স্নোডেনের ফাঁস করে দেওয়া ডকুমেন্টগুলি দেখাচ্ছে, দৈত্যটি বোতল থেকে বেরিয়ে পড়েছে। এত দিন ধরে নানা সমালোচনার উত্তরে নানা বেসরকারি তথ্যসংগ্রহকারী দাবি করে এসেছেন, তাঁদের সংগ্রহ করা তথ্য বিভিন্ন ‘প্রাইভেসি এগ্রিমেন্ট’ দিয়ে সুরক্ষিত। জানিয়েছেন যে, ‘ব্যক্তি’ সম্পর্কে যে তথ্যের বিশ্লেষণ করা হয়, তা আসলে কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তি সম্পর্কে বিশ্লেষণ নয়। যে কম্পিউটার প্রোগ্রাম বিশ্লেষণ করছে, সে শুধু প্যাটার্ন ম্যাচ করছে, একটি নির্দিষ্ট ব্যক্তি সম্পর্কে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছচ্ছে না। অর্থাৎ, ‘ব্যক্তি’ বর্গটিকে বিশ্লেষণের লক্ষ্যবস্তু করা হলেও ‘ব্যক্তিস্বাধীনতা’ লঙ্ঘিত হচ্ছে না। স্নোডেনের দাবি এক লহমায় ভেঙে দিয়েছে সেই মিথ’। স্নোডেন যা দাবি করেছেন (যেটা আংশিক ভাবে মার্কিন সরকার স্বীকারও করেছে, যদিও পুরোটা নয়), সেখানে দেখা যাচ্ছে যে, প্রাইভেসি-টাইভেসিতে গুলি মেরে দুনিয়াজোড়া এই বিপুল তথ্য চালাচালির বৃহদংশই মার্কিন নিরাপত্তা সংস্থার হাতের নাগালে। যে বিপুল পরিমাণ ব্যক্তিগত তথ্যগুলিকে এত দিন স্রেফ মার্কেটিং বা ওই জাতীয় কোনও নির্দোষ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছিল, সেই তথ্যকে ইচ্ছে করলেই একটি নিরাপত্তা সংস্থা ব্যবহার করতে পারে। এ কথা একটি শিশুও জানে যে, কোনও কোম্পানির মার্কেটিং টিম আর সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা চরিত্রে সম্পূর্ণ পৃথক। মার্কেটিং টিম লক্ষ্য স্থির করে একটি বিশেষ গোষ্ঠী বা বর্গের পরিসরে, যাকে পরিভাষায় বলা হয় ‘সেগমেন্ট’, আর গোয়েন্দা সংস্থার লক্ষ্য হল ‘ব্যক্তি’, সুতরাং ‘ব্যক্তিস্বাধীনতা’। অতএব, এই এক ধাক্কায় ভেঙে পড়ছে গণতন্ত্র আর টোটালিটারিয়ান ব্যবস্থার মধ্যের দেওয়াল। ব্যক্তিস্বাধীনতার সমস্ত রক্ষাকবচ হারিয়ে নিরাপত্তারক্ষীদের রক্তচক্ষুর সামনে দুনিয়ার তাবৎ মানুষ আজ নগ্ন। যে নজরদারির জাল বোনা হয়েছে দুনিয়া জুড়ে, ‘নাইনটিন এইটি ফোর’ তার কাছে শিশু। একবিংশ শতাব্দীতে, দেখা যাচ্ছে, বিজনের রক্তমাংস আর কল্পকথা নয়, এমনকী কল্পবিজ্ঞানও নয়, ঘোরতর বাস্তব। নিরাপত্তা সংস্থার যে-কোনও বড় কর্তা, যে-কোনও দিন কম্পিউটারের একটি বোতাম টিপে আপনাকে আমাকে আমাদের পাপের তালিকা দিতেই পারেন। যথা, ‘তাং জুন তেরো ২০১৩, বন্ধুর সঙ্গে তর্কের সময় মাওবাদীরা ‘বেশ করেছে’ বলা’। ঈশ্বরপ্রতিম সেই তথ্যের সামনে শস্যক্ষেত্রের অসহায় কাকতাড়ুয়ার মতো মূক হয়ে গিয়ে আমাদের ‘ও তো তর্কাতর্কির সময় বলেছিলাম’ বলে কিঞ্চিৎ বিড়বিড়িয়ে দোষ স্বীকার করা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না। এই সেই দুনিয়া, যেখানে আপনার ইতিহাস আড়ালরহিত। এই কাফকাসুলভ বধ্যভূমিতে আমাদের উপনীত করার মূল ভগীরথ হলেন এডওয়ার্ড স্নোডেন।
স্নোডেন আইনত অপরাধ করেছেন, তাই ধরা পড়লে, মনে হয়, অন্তত সারা জীবনের জন্য কারাবাস সুনিশ্চিত। আর ধরা না পড়লে নির্বাসন। রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য ফাঁস করার অপরাধে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ যেমন দিন কাটাচ্ছেন ভিনদেশি দূতাবাসের একটি খুপরি ঘরে। এখনও পর্যন্ত চার মিলিয়ন ডলার খরচা করে সে ঘরের সামনে চব্বিশ ঘণ্টা মোতায়েন শহরের পুলিশবাহিনী, ঘরের বাইরে পা রাখলেই যারা তাঁকে গ্রেফতার করবে। এ এক আশ্চর্য সমাপতন যে, শহরটির নাম লন্ডন, যেখানে মৌলবাদী ফতোয়ায় একদা গোপন আস্তানায় দিনের পর দিন কাটিয়েছেন আর এক ভদ্রলোক। সলমন রুশদি। |
|
|
|
|
|