|
|
|
|
হুল্লোড়
|
অপূর্ব বিনোদন C/O স্যার
ছবির বসতি কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের নিজের ঠিকানা। লিখছেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য |
এক বুক অক্সিজেন জোগালেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় এ বার ওঁর নতুন ছবি c/o স্যার দিয়ে।
যা বললাম সেটা উপমা বা রূপকালঙ্কার ঠিকই, কিন্তু এর বাস্তবতা আরও জোরালো। আর তা এ জন্যই শুধু নয় যে ছবিটা আগাগোড়া কার্শিয়াং-এর নয়নাভিরাম নিসর্গে তোলা। বাংলা সিনেমার গেঁতো, বেতো, নিরাপদ পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে কৌশিক এই সেদিন যিনি ‘শব্দ’র মতো কাজ করেছেন একটা অতীব চিত্তাকর্ষক রোমান্টিক থ্রিলার উপহার দিলেন। দেখতে দেখতে বেশ কিছু ইউরোপীয় ও মার্কিন থ্রিলার মনে এল, যা ঠিক ‘ডাউন অ্যান্ড আউট’ গোয়েন্দা গল্প বা মার্ডার থ্রিলার নয়। জীবনের পথ চলতে চলতেই কিছু রহস্যে জড়িয়ে পড়ে মানুষ, কিছু রক্তপাত ঘটে যায়, আকস্মিক ভাবে কিছু প্রেমও। যে রকম পরিস্থিতিতে জড়িয়ে জীবনটাই প্রায় এলোমেলো হতে বসেছিল c/o স্যার-এর শিক্ষক নায়ক জয়ব্রত রায়ের।
অথচ গোড়ায় গোড়ায় c/o স্যারকে ভাবা যেতেই পারত সিডনি পোয়াতিয়ে অভিনীত ষাটের দশকের শেষের মনভরানো, মনকাঁদানো স্কুলজীবনের ছবি ‘টু স্যর উইথ লভ’-এর ধারায় কিছু। রহস্যটা যদিও বেশ বিলম্বিত লয়ে পাকিয়ে ওঠে, কাহিনির প্রথম নাটকীয়/ মানবিক ধাক্কাটা আসে কিন্তু খুব শিগগির শিগগির। যখন জয়ব্রত (যে নিজের পদবি রায় নয়, রে বলে বলতে ও শুনতে অভ্যস্ত)জনৈক প্রপার্টি ডেভেলপার মিস্টার ঘোষের কাছ থেকে প্রস্তাব পায় স্কুল কম্পাউন্ড সংলগ্ন তার পৈতৃক ভিটেটা বিক্রি করে দেবার।
জয়ব্রত ওই স্কুলেই পড়েছে। এখন ওই স্কুলেই শিক্ষক, এবং তিন বছর যাবৎ সম্পূর্ণ অন্ধ। তার হাতের লাঠিটা একটু তেরছা করে ধরা থাকে।
কিন্তু ওর শিরদাঁড়াটা প্রতীকী অর্থে পাইন বৃক্ষের মতো খাড়া। অন্ধ বলে পাহাড়ের উঁচু নিচু রাস্তায় কিছুটা ঝুঁকে হাঁটে, স্কুলের আর দশটা কর্মীর চেয়ে অনেক দূর ও গভীর অবধি দেখতে পায়। প্রস্তাব আসা মাত্র ওর সাফ জবাব ‘না’।
জয়ব্রত চোখে দেখে না বলেই ওর প্রতিবাদটা এত শক্তিশালী দেখায় দর্শকের চোখে। ‘ওয়েট আন টিল্ ডার্ক’ ছবিতে অন্ধ নায়িকা অড্রে হেপবর্নের মরণপণ লড়াইটা যে জন্য আমাদের এত স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। বাড়ি বাঁচানোর টক্করে নেমে জয়ব্রতকে হারাতে হল শিক্ষকের চাকরিটাও। মাইনে চালু থাকবে, তবে চোখের কারণে খাতা পরীক্ষা বা প্রশ্নপত্র তৈরির অক্ষমতাকে কারণ দর্শানো হল ওর অনির্দিষ্ট কালের জন্য ছুটিতে যাওয়ার। জয়ব্রত যোগাযোগ করল ওর সলিসিটার বন্ধু রণবীর মুখোপাধ্যায়কে। বসতবাড়ি ওকে যেনতেনপ্রকারেণ বাঁচাতে হবে, এবং...
রণবীর সঙ্গে সঙ্গে আসতে না পেরে প্রাথমিক কাজ সামলাতে ওর সহকারী সুস্মিতা গুপ্তকে পাঠিয়ে দিল। সে গেস্টরুমে জায়গা পেল জয়ব্রতর বাংলোতে। তত ক্ষণে জয়ব্রতর সহমর্মী সহকর্মী মেঘনা হেডমাস্টারের নির্দেশে এড়াতে শুরু করেছে জয়ব্রতকে। মিস্টার ঘোষের উন্নয়ন পরিকল্পনায় তখন রীতিমতো মরিয়া হেডমাস্টার। ফলে গোটা স্কুল কর্তৃপক্ষ, উন্নয়ন ব্যবসায়ীরা এবং স্থানীয় স্বার্থচক্র এক দিকে, অন্য দিকে একা, অন্ধ ও অনড় জয়ব্রত রে।
সেখানে একটা ম্লান রে অফ হোপ বা আশার আলো সুস্মিতা এবং রণবীর এবং বৃদ্ধ মিস্টার দাস। কিন্তু রহস্য ও অন্ধকার ঘনাতেই থাকে, আর আমাকেও ছবি ও দর্শকের স্বার্থে কাহিনি বিবরণ থেকে সরতে হবে এখানেই। বলতে হবে, ছবি সত্যি কেমন হল। |
|
এককথায়, চমৎকার! লুম্পেনদের উত্থানে এক সন্ত্রস্ত মাস্টারমশাইকে নিয়ে অপূর্ব সামাজিক ছবি ‘আতঙ্ক’ করেছিলেন তপন সিংহ। আর এক অন্ধ কিন্তু নির্ভীক মাস্টারমশাইকে নিয়ে থ্রিলারের মোড়কে এক অন্য আধুনিক বাস্তব নিয়ে ছবি করলেন কৌশিক। সমাজচিত্র এত সুন্দর জায়গা করে নিয়েছে c/o স্যর-এ যে বিনোদিত করার পাশাপাশি ছবিটা কিছুটা সচেতনও করে দর্শককে।
চিন্তা ও বিনোদনের সম্ভারটা সম্ভব করেছে কৌশিকের চিত্রনাট্য। যেখানে দৃশ্য, পরিস্থিতি ও সংলাপের সুন্দর ভারসাম্য। গানের শব্দ ধার করে বললে পকড়। সংলাপ ঝাঁঝালো এবং বাস্তব। উদ্বোধন থেকে পরিণতি অবধি একটা গোছানো ছন্দ ও লয় রক্ষা করা গেছে। আর কাহিনির চরিত্রচিত্রণ তো দারুণ। যা অভিনয়ে অভিনয়ে এতই মনোগ্রাহী যে সিনেমাটোগ্রাফির মতোই চোখ জুড়িয়ে রাখে দর্শকের।
কেবল চোখ জুড়ানো নয়, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের জয়ব্রত রে আমাদের অবাক করে দেয়। এত মার্জিত, সংন্যস্ত অভিনয় জয়ব্রতকে খুব চেনা, জানা, ভাললাগা মানুষ করে দেয়। অন্তত আমার দেখা শাশ্বতর সেরা অভিনয়। জীবনের সেরা অভিনয় সুস্মিতা হয়ে রাইমা সেনেরও। জয়ব্রতকে বলা সুস্মিতার ‘গিভ মি আ হাগ’ চোখে জল আনে। প্রত্যুত্তরে জয়ব্রত হিসেবে শাশ্বতর বলা ‘এটা ঠিক প্রফেশনাল হবে না’ দর্শকের শ্বাস কেড়ে নেয়।
বড় ভাল অভিনয় মেঘনা হিসেবে সুদীপ্তা চক্রবর্তীর, রণবীর হিসেবে ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তের এবং হেডমাস্টার হিসেবে সব্যসাচী চক্রবর্তীর। এতই পেশাদার যে ওঁরা ওই চরিত্র হিসেবেই থেকে যান মনে। পার্শ্বচরিত্রে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, কুণাল পাঢ়ী, অরুণ মুখোপাধ্যায় এবং অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও দিব্যি মানিয়ে গেছেন। আর এত সব অভিনয় ও ওই দৃশ্যপটকে এক সাবলীল, ফ্লুইড ক্যামেরায় বহতা রেখেছেন শীর্ষ রায়। আলোর ব্যবহার, দৃশ্যকোণ এবং শট সিলেকশনে আজকের ফিল্ম নির্মাণের ঝাঁঝ ও পরিণতি আছে। যা সম্পাদনার কাজেও নজরে এল।
রাজা নারায়ণ দেবের সুরারোপ ভাল, তবে তা নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়ার মতো কিছু নেই। বিশেষত একটা গান বার বার চালিয়ে একটা মিউজিক্যাল কমেন্ট্রির মতো কিছু দাঁড় করানোর যে ফর্মুলা বাজারে চলছে তা থেকে c/o স্যার কেন বেরোতে পারল না, ভেবে অবাক হচ্ছি। এর জন্য সুরকারের ওপর কোনও দায় বর্তায় না অবশ্যই।
কাহিনি ও চিত্রনাট্যের কিছু দোষ চোখ এড়ায় না। সুস্মিতা শেষ দিকে জানায় কার্শিয়াং-এ চার দিনের অভিজ্ঞতা ওকে আমূল বদলে দিয়েছে। তাই কি? জয়ব্রতর চাকরি খোয়ানো থেকে চাকরি ফিরে পাওয়া সব চার দিনে? কলকাতার গলিতে খুন এবং কার্শিয়াং-এর খুন নিয়ে দর্শকের ধোঁয়াশা কিন্তু থেকেই যায়। প্লট টু প্লট বাঁধুনি সেখানে জোরালো নয়। স্কুলের ছেলেটা মার খেল কেন? হেডমাস্টারের প্ররোচনায় জয়ব্রতর সঙ্গে মেঘনার সম্পর্কছেদ কি নেহাতই চার-পাঁচ দিনের? কাহিনি ও চিত্রায়ণের প্রবাহ দেখে কিন্তু তা মনে হয় না। এছাড়া ছবির প্রথম দিকে মাঝে মাঝে সাদা-কালো দৃশ্যের অবতারণার সিনেম্যাটিক লজিকটা ঠিক কী?
এই প্রশ্নগুলো অবশ্যই ‘C/Oস্যার’-এর অপূর্ব বিনোদনকে খর্ব করে না। নানা দিক থেকে ছবিটার প্রতি এত আকর্ষণ বোধ করলাম যে কৌশিকের আগামী সব ছবির জন্য মুখিয়ে থাকব। মানুষটি নিজের মতো করে ভাবতে জানেন এবং তা সিনেমায় প্রকাশ করতে পারেন। এও মনে হল যে, যে ঋতুপর্ণ ঘোষকে তাঁর শ্রেষ্ঠ শিক্ষক শনাক্ত করে তাঁকে উৎসর্গ করেছেন এ ছবি, তাঁর প্রভাব থেকে তিনি সম্পূর্ণ মুক্ত। এ ছবির বসতি C/O স্যার-এ নয়, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের নিজের ঠিকানায়। |
|
|
|
|
|