সম্প্রতি পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রচারে বাঁকুড়ার খাতড়ায় গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, কিষাণ ক্রেডিট কার্ড না পেলে নির্বাচনের পর ব্যাঙ্কগুলির সামনে গিয়ে ধর্না দিতে, আন্দোলন করতে। প্রশাসনের শীর্ষ কর্তার থেকে এমন নির্দেশ কিছুটা আশ্চর্য বইকী। তবে জননেত্রী মমতা হয়তো টের পেয়েছিলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির অসহযোগিতায় চাষিদের মধ্যে ক্ষোভ জমা হচ্ছে।
কিষাণ ক্রেডিট কার্ড হাতে না পাওয়ায় রাজ্য সরকারের নানা সুযোগ সুবিধে থেকে চাষিরা বঞ্চিত হচ্ছেন, এমন বেশ কিছু অভিযোগ জমা পড়েছে রাজ্য কৃষি দফতর এবং স্টেট লেভেল ব্যাঙ্কারস্ কমিটির কাছে। কৃষি দফতরের তরফে অভিযোগগুলি দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
রাজ্য কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, কিষাণ ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ঋণ এবং শস্যবিমা ছাড়াও, আরও দু’টি প্রকল্পের সুবিধে পেতে পারেন চাষিরা। এক, কৃষি যন্ত্রপাতি কিনতে ভর্তুকি এবং এককালীন অনুদান দেওয়ার প্রকল্প, বা ‘ফিনান্সিয়াল সার্পোট স্কিম ফর ফার্ম মেকানাইজেশন।’ অন্যটি হল ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের ছোট যন্ত্রপাতি কেনার জন্য এককালীন অনুদান বা ‘ওয়ান টাইম অ্যাসিস্টেন্স ফার্মার ফর পারচেজ অফ স্মল ইমপ্লিমেন্টস।’
প্রতিটি জেলাস্তরে কৃষি দফতরের এক জন সহকারী অধিকর্তাকে দু’টি প্রকল্পের দেখভাল ও রূপায়ণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দু’টি ক্ষেত্রেই চাষিদের তরফে আবেদন জমা পড়ে। ‘আগে আবেদন করলে আগে পাবে’ ভিত্তিতে চাষিদের নির্বাচিত করা হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই নির্বাচিত হয়েও চাষিরা টাকা পাননি। অভিযোগ উঠেছে, ব্যাঙ্ক আধিকারিকদের অসহযোগিতার জন্য কিষাণ ক্রেডিট কার্ড পাচ্ছেন না চাষিরা, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টও খুলতে পারছেন না। তাই এই সমস্যা হচ্ছে।
কৃষি দফতরের এক আধিকারিক বলেন, “উচ্চস্তরে প্রশাসনিক বৈঠক ডাকা হলে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের স্থানীয় শাখাগুলির প্রতিনিধিরা চাষিদের সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটছে না।” বেশ কয়েকটি ব্যাঙ্কের শাখার স্থানীয় কর্তৃপক্ষ চাষি এবং কৃষি দফতরের কর্মীদের সঙ্গে ‘অসৌজন্যমূলক’ আচরণ করেছেন বলেও অভিযোগ করছেন ওই আধিকারিক।
কী বলছেন চাষিরা? কাঁকসা ব্লকের চাষি সুনির্মল মাজি বলেন, “আমি ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট করতে গিয়েছিলাম। সব কাগজপত্র জমা দেওয়ার পরেও সাত দিন ধরে ঘোরানো হয়েছে। তিন মাস পরে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। কিন্তু প্রকল্পের সুবিধে পাওয়ার সময় পেরিয়ে যাওয়ায় আমার কোনও লাভ হয়নি।” নদিয়ার গাংনাপুর এলাকার সব্জি চাষি অসিত বিশ্বাস বলেন, “ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলতে ছ’মাস ঘুরতে হয়েছে। কৃষ্ণনগরে হেড অফিসের কর্তারা বলে দিলেও স্থানীয় শাখার কর্মীরা কোনও পাত্তা দেননি। ব্যাঙ্কে গেলেই বলে দেওয়া হয়, অন্য কাজ রয়েছে পরে আসুন। পঞ্চায়েতের কর্তারা বলে দিলেও তা শোনা হয়নি।”
ব্যাঙ্কের কর্তারা অবশ্য এই অভিযোগ মানতে নারাজ। বর্ধমান জেলার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের দুর্গাপুরের এক ব্রাঞ্চ ম্যানেজার বলেন, “আমরা সব সময়ে চাষিদের সাহায্য করি। কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নির্দেশিকা অনুযায়ী ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে বেশ কিছু কাগজপত্র লাগে। কিছু চাষি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে আসেন না, কাগজ চাইলে তাঁরা বিরক্ত হন। ফের ব্যাঙ্কে এসে তা জমা দেন না। অ্যাকাউন্ট খোলা সম্ভব হয় না। অথচ অন্যত্র অভিযোগ করেন, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলেনি।”
গ্রামীণ এলাকাতে গরিবদের ব্যাঙ্কিং পরিষেবার আওতায় আনার জন্য ব্যাঙ্ক কর্মীরাই যাবেন চাষিদের কাছে, এমন নির্দেশও রয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের। কিন্তু ব্যাঙ্ক কর্মীদের দাবি, এমনিতেই গ্রামীণ শাখাগুলিতে কর্মী সংখ্যা কম। তাই কাজের চাপ বেশি। সেই কাজ সেরে ব্যাঙ্ক আ্যাকাউন্টের কাগজপত্র চাষিদের বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা সম্ভব নয়।
কেন্দ্রীয় কৃষি দফতরের সূত্র অনুসারে, ২০১২ সালের মার্চ মাস অবধি পশ্চিমবঙ্গে সর্বাধিক কিষাণ ক্রেডিট কার্ড বিলি করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি (১৯ লক্ষ), তারপর সমবায় ব্যাঙ্ক (১৬ লক্ষ) এবং তারপর গ্রামীণ ব্যাঙ্কগুলি (৭ লক্ষ)। বিহার, কর্ণাটক, তামিল নাড়ু সহ অনেক রাজ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি অনেক বেশি কার্ড বিলি করেছে। আবার ওড়িশা, রাজস্থানের মতো কিছু রাজ্যে সমবায় ব্যাঙ্কগুলি বিলি করেছে বেশি কার্ড। বড় রাজ্যগুলির মধ্যে মোট কিষাণ ক্রেডিট কার্ড সংখ্যার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ (৪৩ লক্ষ) অনেকটাই পিছিয়ে। অতএব ব্যাঙ্কিং পরিষেবাকে কোন পথে, কোন কৌশলে পৌঁছনো যায় চাষিদের কাছে, তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে রাজ্যকে।
তবে কৃষি দফতরের দাবি, ২০১২-১৩ সালে ৩০ হাজার চাষির কাছে ছোট কৃষি যন্ত্রপাতি দেওয়া গিয়েছে। আর ট্র্যাক্টর, পাওয়ার টিলার প্রভৃতি কৃষিযন্ত্র দেওয়া হয়েছে ৪৭ হাজার। কিন্তু চাহিদা অনেক বেশি। কৃষির স্বার্থেই গ্রামীণ ব্যাঙ্ক পরিষেবায় ব্যাপ্তি আনা দরকার হয়ে পড়েছে।
|
কৃষিযন্ত্রের জন্য আর্থিক সহায়তা
(ফিনান্সিয়াল সাপোর্ট স্কিম ফর ফার্ম মেকানাইজেশন) |
• কী কী কেনা যাবে:
ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, জিরো টিলেজ মেশিন, পাম্পসেট,
প্যাডি ট্রান্সপ্লানটার, প্যাডি হারভেস্টর ইত্যাদি।
|
• সরকার কী দিচ্ছে:
১০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা ভতুর্কি।
|
• শর্ত:
কিষান ক্রডিট কার্ড থাকতে হবে।
|
• পদ্ধতি:
ভর্তুকির টাকা সরকার সংশ্লিষ্ট চাষিদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে দেবে।
চাষিরা পছন্দমত যে কোনও সংস্থার তৈরি যন্ত্রপাতি কিনতে পারেন।
|
ছোট কৃষিযন্ত্রের জন্য এককালীন অনুদান
(ওয়ান টাইম অ্যাসিস্টেন্স ফর পারচেজ অব স্মল ইমপ্লিমেন্টস) |
• কী কী কেনা যাবে:
লাঙলের ফলা, কোদাল, ধান ঝাড়ার মেশিন, সেচের জল
দেওয়ার পাইপ, স্প্রেয়ার, কনোউইডার, ড্রামসীডার ইত্যাদি।
|
• সরকার কী দিচ্ছে:
এককালীন পাঁচ হাজার টাকা।
|
• শর্ত:
কিষান ক্রেডিট কার্ড না থাকলেও ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে। |
|