|
|
|
|
ভোট বয়কটের হুমকি দিয়ে রাস্তা পেল রংপুর
কিংশুক গুপ্ত • বেলপাহাড়ি |
গ্রামে রাস্তা নেই। নদী পেরনোর সেতু নেই। নেই পরিস্রুত পানীয় জল। বাসিন্দারা তাই উন্নয়নের দাবিতে ভোট বয়কটের হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। আর তারপরই রাতারাতি কাজ শুরু হয়েছে। তৈরি হচ্ছে রাস্তা, বসানো হচ্ছে নলকূপ।
ঘটনাস্থল মাওবাদীদের ধাত্রীভূমি বেলপাহাড়ি। এখানকার ভেলাইডিহা পঞ্চায়েতের রংপুর গ্রামের বাসিন্দারা প্রতিবারই ভোটের আগে নানা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি শুনেছেন। কিন্তু ভোট মিটতেই যে কে সেই। তাই এ বার পঞ্চায়েতে নির্বাচনের দিন ঘোষণা হতেই গ্রামবাসীরা এককাট্টা হয়ে সিদ্ধান্ত নেন, উন্নয়ন না হলে ভোট দেবেন না। তাঁদের দাবি ছিল, রাস্তা, নলকূপ, প্রাথমিক স্কুল, তারাফেনি নদীর উপর সংযোগকারী সেতু। গ্রামে ভোটার নেহাত কম নয়, মোট ৫৬২ জন। তার উপর এলাকাটি একদা মাওবাদী ঘাঁটি ছিল। এখানে ভোট বয়কট হলে অন্য বার্তা যাবে। প্রশাসন তাই তড়িঘড়ি কাজ শুরু করে দেয়। গত দশ-পনেরো দিনে মোরাম ফেলে কুশমুড়া থেকে নদীঘাট এবং নদীর অপর প্রান্ত থেকে গ্রামের ভিতর পর্যন্ত দেড় কিলোমিটার রাস্তা তৈরি হয়ে গিয়েছে। অঙ্গনওয়াড়ি চত্বরে নলকূপ বসানোর জন্য মাটি পরীক্ষা চলছে। ভোটের আগেই নলকূপ বসানো হবে। |
|
বেলপাহাড়ির রংপুর গ্রামে রাতারাতি মোরাম ফেলে তৈরি হচ্ছে রাস্তা।—নিজস্ব চিত্র |
প্রশাসন অবশ্য বলছে, ভোটকর্মীদের জন্যই উন্নয়নের কিছু কাজ হচ্ছে। এর সঙ্গে ভোট বয়কটের হুমকির কোনও সম্পর্ক নেই। বেলপাহাড়ির বিডিও সর্বোদয় সাহার বক্তব্য, “ভোটকেন্দ্রের অ্যাপ্রোচ রোড তৈরির জন্য অনেক আগেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।’’ তবে গ্রামবাসীরা তা মানতে নারাজ। তাঁদের যুক্তি, আগেও তো গ্রামে ভোট হয়েছে। কই তখন তো রাস্তা হয়নি, অঙ্গনওয়াড়িতে নলকূপ বসেনি! বিকাশ গরাই, কবিতা গরাই, বিনোদ গিরিরা বলেন, “যে রাস্তা তৈরি হল নদীতে সেতু না থাকায় তাতে যানবাহন চলে না। ফলে, ওই রাস্তা দিয়ে ভোটকর্মীরা আসবেন কী করে? প্রত্যেক বার তো ভোটকর্মীরা বেলপাহাড়ি ব্লক সদর থেকে গাড়িতে করে কেচন্দা ও জামডহরি গ্রামের রাস্তা ধরে রংপুরে আসেন।” ভোট বয়কটের হুমকিতেই যে কাজ হয়েছে, তা মানছে প্রশাসনের একাংশ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা প্রশাসনের এক আধিকারিক বলেন, “মাওবাদী এলাকা বেলপাহাড়িতে ভোট বয়কট হলে প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরে ভুল বার্তা পৌঁছতে পারে। তাই ভোট কেন্দ্রে পৌঁছনোর অজুহাতে রাস্তা তৈরি হল। ভোটের আগে টিউবওয়েলও হবে। আর ভোট মিটলে স্কুল ও সেতু তৈরি হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।”
রংপুর গ্রামে সব মিলিয়ে ১২০টি পরিবারের বাস। বেশিরভাগ বাসিন্দাই কৃষিজীবী। অনেকে আবার গরুর দুধের ব্যবসা করেন। দৈনন্দিন প্রয়োজনে ও দুধ বেচতে নদী পেরিয়ে কুশমুড়া হয়ে সাইকেলে ৭ কিলোমিটার দূরে শিলদা বাজারে যেতে হয় বাসিন্দাদের। অথচ গ্রামে কোনও ভাল রাস্তা নেই। বৃষ্টি হলে একহাঁটু কাদা ভেঙে যাতায়াত করতে হয়। তারাফেনি নদীতে জল বাড়লে সাইকেল নিয়ে পেরনো অসম্ভব। কারণ, খরস্রোতা এই নদীতে খেয়া পারাপারের ব্যবস্থা নেই। তখন ঘুরপথে ১৫ কিলোমিটার পথ উজিয়ে শিলদা পৌঁছনো ছাড়া উপায় নেই।
মাস খানেক আগে প্রবল বৃষ্টির রাতে গ্রামের এক বৃদ্ধ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারাফেনি তখন ফুঁসছে। ঘুরপথে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার পথেই মৃত্যু হয় ওই বৃদ্ধের। এরপরই গত ১০ জুন রংপুর গ্রামের বাসিন্দারা পুলিশ-প্রশাসনে লিখিত ভাবে জানিয়ে দেন, এ বার তাঁরা পঞ্চায়েত ভোট বয়কট করবেন। এরপরই তড়িঘড়ি রাস্তা তৈরি ও নলকূপ বসানোর সিদ্ধান্ত নেয় প্রশাসন।
কিন্তু এত দিন কেন কাজ হয়নি? ভেলাইডিহা গ্রাম পঞ্চায়েতে ক্ষমতায় ছিল ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন)। স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য সিপিএমের শিবনাথ শবর বলেন, “আমি বিরোধী সদস্য বলে আমার কথায় পাত্তাই দিত না।” বিদায়ী ঝাড়খণ্ডী প্রধান বৈদ্যনাথ গোয়াল অবশ্য মন্তব্য করতে চাননি। তবে তাঁর দলনেত্রী চুনিবালা হাঁসদার দাবি, “যে সব কাজের কথা বলা হচ্ছে, তা তো পঞ্চায়েত করে না। ব্লক প্রশাসন করে।” প্রশাসনের উদ্যোগেই শেষমেশ কাজ হচ্ছে রংপুরে। তাই গ্রামবাসীরাও প্রশাসনকে জানিয়েছেন, এ বার ভোট দেবেন। গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দারা কিছুটা দোলাচলে। জার্মান গরাইয়ের মতো কয়েকজন বলছেন, “আমরা তো ঘরপোড়া গরু। ভোট হয়ে গেলে তখন হয়তো আবার সব কাজ বন্ধ হয়ে যাবে!” |
|
|
|
|
|