দানি আলভেজের হাতে ওটা কী? মারাকানার সত্তর হাজারের ‘ওলে..ওলে’ শব্দব্রহ্মের তালে তালে যেটা আলভেজ বাজিয়ে চলেছেন? কলকাতায় ওটাকে ঢোল বলত। রিও-তে কী বলে কে জানে! অদ্ভুতদর্শন ওই বাদ্যযন্ত্রের মাথাটা আবার খুলে নেওয়া হয়েছে। ওটা, ততক্ষণে দাতে-র হাতে।
কয়েকশো ডেসিবেলের সাউন্ড সিস্টেমে নাম ঘোষণা শেষ। ফিফার মহাকর্তা সেপ ব্লাটার পুরস্কার হাতে দাঁড়িয়ে, পোডিয়ামে পৌঁছতে হবে তাড়াতাড়ি। কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে তো উঠে আসতে হবে ‘বিগ ফিল’-কে। এক-একটা ধাপ উঠছেন, আর অগুনতি হাত এগিয়ে আসছে। কেউ একটু ছুঁয়ে দেখতে চায়, কেউ তাঁর ওই দুর্ধর্ষ ফুটবলমগজে দিতে চায় সস্নেহ চুম্বন। এক সময় এরাই লুই ফিলিপ স্কোলারিকে ‘গাধা’ বলেছিল না?
জিভটা বেরিয়ে আসছে মাঝে-মাঝেই। হাতের তালু দিয়ে মুহূর্তে সৃষ্টি করছেন আশ্চর্য সব মুদ্রা। ইনিয়েস্তাকে ‘সেকেন্ড বয়’ করে প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্টের স্বর্ণপদক গলায় পরছেন, আর মারাকানা টানা চিৎকার করে চলেছে, ‘নেইমার...নেইমার...।’ তিনি আর শুধু অসম্ভব প্রতিভাসম্পন্ন ফুটবলার নন। নেইমার আজ থেকে মহাতারকা। কিছুটা শিশুসুলভ, কিছুটা পাগলাটে! |
ফাইনাল দেখতে বসে এ রকম হেনস্থা কপালে লেখা ছিল, কে জানত! জেরার পিকে লাল কার্ড দেখতেই কানের কাছে চালু হুল ফোটানো বিদ্রূপ, ‘শাকিরা..শাকিরা..।’ কয়েক সেকেন্ডে নতুন চুটকি, ‘দ্য রেফ’স লিপস ডোন্ট লাই...।’ শাকিরার বিখ্যাত ‘হিপস ডোন্ট লাই’-এর প্যারোডি!
স্বপ্নের ফাইনাল ও তার কিছু স্বপ্নের মুহূর্ত। যা তিকিতাকা নামক মারণ-স্ট্র্যাটেজির মৃত্যু দেখল যেমন, ঠিক তেমনই রবিবারের মোহিনী রাত ফুটবলবিশ্বে একটা সদম্ভ ঘোষণা করে রাখল। দেশ-বিদেশের কাগজে, ফুটবল বিশেষজ্ঞদের টেবলে যার প্রতিফলন।
ব্রাজিলের পুনর্জন্ম!
নেইমার যেমন বাক্রহিত। জয়ের মাহাত্ম্য বুঝে উঠতে পারছেন না। বলেছেন, “বিশ্বাস করুন, আমি জানি না। শুধু জানতাম এই টুর্নামেন্টটা আমাদের জেতা দরকার ছিল। গোটা বিশ্ব স্তব্ধ হয়ে ম্যাচটা দেখেছে। আর জানি যে আমরা দুর্দান্ত খেলেছি।” কিন্তু ভাবতে পেরেছিলেন ব্রাজিল এ ভাবে চ্যাম্পিয়ন হতে পারে? এ বার উত্তরে একগাল হাসি, “নাহ্। ড্রেসিংরুমে সেটাই বলাবলি করছিলাম যে, দেখো কী ভাবে আমাদের জন্য সব ঠিকঠাক হয়ে গেল।” স্কোলারি আবার বলে রেখেছেন, “সামনের বছর আরও কঠিন পরীক্ষা। বিশ্বকাপে আমরা আরও আত্মবিশ্বাস নিয়ে নামতে পারব।” আর ভিসেন্তে দেল বস্কি? স্পেনের কোচ স্বীকার করে নিয়েছেন, “অজুহাত দেব না। ব্রাজিল আমাদের শেষ করে দিয়েছে।” |
স্প্যানিশ মিডিয়াও ব্রাজিল-বন্দনায় আছন্ন। কোথাও লেখা হয়েছে, নেইমার আমাদের ‘খুন’ করে দিল। কোথাও ফ্রেডকে বলা হচ্ছে নিঃশব্দ নায়ক। দু’দেশের মিডিয়াই লিখে ফেলেছে রিও বিশ্বকাপে ফেভারিট ব্রাজিলই। কোথাও একধাপ এগিয়ে লেখা, চ্যাম্পিয়নদের কী ভাবে চুপ করিয়ে দিতে হয়, দেখিয়ে দিল ব্রাজিল!
ফুটবলবিশ্বও তো বলছে। বলছে, কোথাও যেন শেষ পর্যন্ত জিতে গেলেন কার্লোস আলবার্তো পাহিরা। পাহিরা কথা দিয়েছিলেন, তিকিতাকাকে ধ্বংস করে দেবেন। দিয়েছেন। নেইমাররা দেখিয়ে দিয়েছেন, টিম আসে, টিম যায়। যুগ আসে, যুগ যায়। শুধু চিরকালীন শ্রেষ্ঠত্বের মহাপরীক্ষা এলেই গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে হলুদ জার্সি, জন্ম হয় নতুন যুগের, রিও থেকে রাসবিহারী কোটি কোটি ফুটবল-পাগলের কণ্ঠস্বর মিলে যায় তিন অক্ষরে।
ব্রা-জি-ল!
|
আত্মসমর্পণের পাঁচ-কাহন |
১. স্পেনের বিরুদ্ধে অতি প্রসিদ্ধ ‘বাঙ্কার অ্যান্ড কাউন্টার’ স্ট্র্যাটেজিতে খেলেছে ব্রাজিল। গতি দিয়ে প্রতি আক্রমণ করা ছাড়াও স্পেনের মাঝমাঠের সব তারকাদের ম্যান মার্ক করে রাখে। ফাইনাল থার্ডে পৌঁছেও বল হারায় স্পেন।
২. ফ্রেড-নেইমার-অস্কারের ত্রিমুখী আক্রমণ থামানোর কোনও ছক ছিল না দেল বস্কির কাছে। নিজেদের মধ্যে ৮৭ শতাংশ নিখুঁত পাস খেলেন নেইমাররা।
৩. স্পেনের স্ট্রাইকারদের ধারাবাহিকতার অভাব। সুযোগ তৈরি করলেও ফের্নান্দো তোরেস কাজে লাগাতে পারেননি। দাভিদ ভিয়া পরিবর্তে নেমেও গোল পাননি।
৪. দাভিদ লুইজের ব্লকবাস্টার পারফরম্যান্স। স্পেনের সব আক্রমণের আগুন নিভিয়ে ব্রাজিলের আক্রমণে অনবরত বল জোগানো। এমনকী পেড্রোর শট গোল লাইন থেকেও বাঁচান।
৫. ডাবল পিভোটে খেলে গুস্তাভো ও পওলিনহো সারাক্ষণ আক্রমণে সাপোর্ট দিয়েছেন। আবার নীচে নেমে ডিফেন্সও সামাল দিয়েছেন। |
|