উইম্বলডনের ‘মিড সানডে’-তে লন্ডনে এক বন্ধুর বাড়ি লাঞ্চে এসে আড্ডার সিংহভাগ দেখলাম টেনিস। ব্রিটিশ কাগজগুলোর খেলার পাতাতেও তাই। রবিবারই লাতিন আমেরিকায় স্পেন বনাম ব্রাজিলের যে একটা হাইভোল্টেজ ফুটবল ফাইনাল আছে, বিলেতে বসে অন্তত বোধগম্য হওয়ার নয়। এমনই মাহাত্ম্য উইম্বলডনের!
ভুল বললাম। অ্যান্ডি মারে আর লরা রবসন মাহাত্ম্য! ইংরেজদের এক নম্বর ছেলে আর মেয়ে টেনিস তারকা। মানের তফাত অবশ্য আকাশ আর পাতালেরও বেশি। তাতে কী? ব্রিটিশ সংবাদপত্রে হেডিং দেখলাম, ‘মারে-লরা টেনিসের স্বর্গীয় জুড়ি!’ মারে নিয়ে নতুন করে বলার নেই। কিন্তু ষোড়শী লরা? পনেরো বছর পর প্রথম ব্রিটিশ মেয়ে হিসেবে উইম্বলডনের শেষ ষোলোয় উঠতেই ওকে এখানকার হুজুগে ট্যাবলয়েডগুলো যেন চ্যাম্পিয়নের প্রচার দিচ্ছে! লরার আর একটা রেকর্ডের কথা শুনবেন? ফোর্থ রাউন্ডে হারলেও পরের সপ্তাহে বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে প্রথম তিরিশের মধ্যে চলে আসবে মেয়েটা। এক্ষেত্রে এপ্রিল, ১৯৮৭-তে জো ডুরি-র পর প্রথম ব্রিটিশ মেয়ে লরা। আমার মতে লরা প্রথম সারির না হোক, ভাল প্লেয়ার। বাঁ-হাতি বলে বছর কয়েক আগের কিভিতোভার মতো একটা অন্য রকম চমক রয়েছে। |
স্ট্রবেরি আর ক্রিম ছাড়া উইম্বলডন ভাবা যায়? টুইটারে জিজ্ঞাসা সানিয়া মির্জার। |
আসল কিভিতোভাকে কিন্তু এ বার দু’বছর আগের উইম্বলডন চ্যাম্পিয়ন কিভিতোভার ছায়া লাগছে আমার। তার ওপর শারাপোভা-আজারেঙ্কা, সবাই ছিটকে যাওয়ায়, মেয়েদের সিঙ্গলসের নীচের অর্ধটা একেবারে ‘ওয়াইড ওপেন’। কে যে ফাইনালে সেরেনার মুখে পড়বে বলা মুশকিল। লরা রবসন? ‘ড্র’ অনুযায়ী কোয়ার্টার ফাইনালে সেরেনার সামনে পড়ছে বলে ওখানেই ওর দৌড় শেষ ধরে নেওয়া যায়। সেরেনাকে ফাইনালিস্ট ধরে নিচ্ছিই কেন? শুধু ফাইনালিস্ট নয়। সেরেনা বাদে সামনের শনিবার সেন্টার কোর্টে অন্য কারও হাতে চ্যাম্পিয়নের রুপোর থালাটা দেখতে পাচ্ছি না। এতটাই নিখুঁত ফর্ম আর ফিটনেস এখানে দেখছি সেরেনার। টেনিস সার্কিটে আমার বহু দিনের বন্ধু টনি রোচ মজা করে বলছিল, সেরেনা একমাত্র পা পিছলে পড়লেই হারতে পারে। আমি বলেছি, ও কোর্টে হড়কাতে পারে, কিন্তু হারবে না। এতটাই ধারাবাহিক দুধর্র্র্ষ খেলছে। চতুর্থ রাউন্ড টপকালে সেরেনা ওর দিদি ভেনাসের টানা ৩৫ ম্যাচ অপরাজিত থাকার তেরো বছরের পুরনো রেকর্ড ছোঁবে।
অভূতপূর্ব অঘটনের হিড়িকে ছেলেদের সিঙ্গলসেও বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে ১৩০ নম্বর (লুকাস কুবোট), ১১১ নম্বরের (মানারিনো) মতো অখ্যাতরা কেরিয়ারে এই প্রথম উইম্বলডনে দ্বিতীয় সপ্তাহের মুখ দেখছে। তা সত্ত্বেও একটা সম্ভাব্য সেমিফাইনাল লাইন আপ দেখছি। সেটা আমার মতে জকোভিচ বনাম দেল পোত্রো এবং মারে বনাম পোলিশ বিগ সার্ভার জের্জি জাঙ্কোভিচ। শুধু বিগ সার্ভার বললেই সব বলা হয় না। এখানে জাঙ্কোভিচের মতো ভয়ঙ্কর জোরালো আর নিখুঁত সার্ভ করতে এখনও কাউকে দেখিনি। তবে ট্রফি-ফেভারিট অবশ্যই জকোভিচ আর মারে। ডার্ক হর্স দেল পোত্রো। কারণ ওর গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতার অভিজ্ঞতা আছে। উইম্বলডনেই গত বার জকোভিচকে হারিয়ে অলিম্পিক ব্রোঞ্জ জিতেছে। তবে জকোভিচ এই মুহূর্তে নিঁখুত টেনিস খেলছে। সবচেয়ে বড় কথা, খেলাটাকে উপভোগ করছে। যেটা চাপ কাটিয়ে ভাল পারফরম্যান্স করার জন্য যে কোনও প্লেয়ারের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ।
মারে আবার এখানটায় পিছিয়ে। দুর্দান্ত খেলছে সন্দেহ নেই। সে তো ও শেষ যে তিনটে গ্র্যান্ড স্ল্যাম খেলেছে, তার প্রত্যেকটায় ফাইনাল খেলাতেই স্পষ্ট। কিন্তু নিউইয়র্ক-মেলবোর্ন আর লন্ডন মারের কাছে এক বস্তু নয়। উইম্বলডনে প্রতিটা ম্যাচেই গোটা ব্রিটেনবাসী, ব্রিটিশ মিডিয়ার অসীম প্রত্যাশার অনন্ত চাপ মারের ঘাড়ে। পৌনে একশো বছরেও কোনও ব্রিটিশের উইম্বলডন চ্যাম্পিয়ন হতে না পারার অসহ্যকর চাপ। যার জন্যই হয়তো মারে বলেছে, অলিম্পিক সোনা জেতার চেয়ে ওর কাছে নাকি আর কিছু কখনও বড় হবে না! স্রেফ নিজের ওপর থেকে চাপ কমানোর ট্যাকটিক্স। পরের রবিবার ফাইনালে জকোভিচের থেকেও মারের বড় প্রতিপক্ষ আমার মতে ব্রিটিশ মিডিয়া। এখন থেকেই ওকে যে ভাবে মহাগুরু বানানো চলছে এখানকার সব কাগজে-চ্যানেলে!
আর একটা কথা। বেশ কয়েক বছর পর উইম্বলডনের দ্বিতীয় সপ্তাহে ডাবলসে এতগুলো ভারতীয় জুটি দেখার সৌভাগ্য হচ্ছে। সব মিলিয়ে সাতটা। এর মধ্যে সানিয়া মির্জার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে ভাল। ডাবলস (লিজেল হুবার) আর মিক্সড ডাবলস (হোরিয়া তেকাউ), দুটোতেই ওর পার্টনার খুব ভাল। মিক্সড-এ তো সানিয়ারা দ্বিতীয় বাছাই। আর সানিয়া নিজেও এখানে খুব ভাল খেলছে। আগের চেয়ে অনেক ভাল রিটার্ন করছে। পুরুষ ডাবলসে লিয়েন্ডার-স্টেপানেক জুড়িরও ভাল করা উচিত। স্টেপানেক সিঙ্গলস থেকে নাম তুলে নিয়ে, চোট সারিয়ে ডাবলসে পুরো মনোযোগ দিয়েছে। তবে মহেশেদের জুটির কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রায়ান ভাইদের সামনে পড়ার কথা বলে ওদের নিয়ে তেমন আশা দেখছি না। |