অস্ট্রেলিয়ার ‘এমু’ কোচবিহারের প্রত্যন্ত গ্রামে। সকাল থেকে রাত মাঠে দৌড়ে বেড়াচ্ছে এমু পাখির দল। তাদের দেখতে উপচে পড়ছে ভিড়। কেউ এক বার ছুঁয়ে দেখছে এমুকে। কেউ সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছে খাবার। ছড়িয়ে দিচ্ছে এমুর দলের দিকে। তারাও খুশি হয়ে কাছাকাছি আসতে চায় মানুষের। কোচবিহার শহর থেকে প্রায় ১৫ কিমি দূরে টাপুরহাট সংলগ্ন বড়ুয়াপাড়া যেন এমু পাখিদের গ্রাম।
পাখিদের পরিচর্চার দায়িত্বে থাকা প্রদীপ অধিকারী বলেন, “ব্যবসায়িক ভিত্তিতেই ওই পাখির চাষ করা হচ্ছে। তবে এখনও কোনও পাখি বিক্রি করা হয়নি। আপাতত সেগুলিকে বড় করা হচ্ছে। পাখি দেখতে রোজ ভিড় করছে মানুষ। তাতে আমাদেরও খুব ভাল লাগছে।” এলাকার বাসিন্দারা বলেন, “এই ধরনের পাখি আমরা টিভিতে দেখেছি। আশেপাশের এলাকার বাসিন্দারাও কখনও দেখেননি বলেই জানি। এ বার সামনে থেকে এমু পাখি দেখে খুব ভাল লাগছে।” |
পঞ্চায়েত সূত্রে খবর, বছর দুয়েক আগে তোর্সার চর সংলগ্ন এলাকায় কয়েক একর জমি কিনে একটি ফার্ম হাউস তৈরি করে খাগড়াবাড়ির একটি সংস্থা। সেই সময় পুনে থেকে ৯০ টি এমু নিয়ে এসে সেখানে রেখে পরিচর্চা শুরু করে তারা। পরে সেটি ফালাকাটার একটি সংস্থার কাজে বিক্রি করে দেওয়া হয়। বর্তমানে ওই সংস্থার তরফেই এমু পাখির চাষ করা হচ্ছে। ওই ফার্মের ম্যানেজার প্রদীপবাবু জানান, ২৫ হাজার টাকা জোড়া হিসাবে পুনে থেকে ট্রাকে করে অল্প বয়স্ক এমু পাখিগুলি আনা হয় বড়ুয়াপাড়ায়। বছর দুয়েকের মধ্যে বেশ কয়েকটি পাখি মারাও যায়। বর্তমানে ৭০ টি পাখি ফার্মে রয়েছে। সেগুলি ৪ থেকে ৫ ফুট উচ্চতার হয়েছে। এক একটির ওজন ১০ কিলোগ্রাম ছাড়িয়ে গিয়েছে। এলাকার বিদায়ী পঞ্চায়েত সদস্য ফুলমনি রায় বলেছেন, “এমু পাখির কথা শুনে প্রচুর লোক বাইরে থেকে আসেন। আমরাও প্রথমের দিকে বেশ কয়েক বার সেখানে গিয়ে দেখেছি। ওই পাখিগুলি দেখতে খুব সুন্দর।” এখানকার ফার্মে গত দুই বছরের মধ্যে ৮০টি ডিম দিয়েছে এমু পাখির দল। একেকটি ডিমের ওজন ৮০০ গ্রাম। সেই ডিম ফুটিয়ে এমু পাখির ছানা করার চেষ্টা করেছিল ওই সংস্থা। প্রজননের চেষ্টা সফল হয়নি।
|
এমু পাখি
অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় পাখি |
ব্যবসায়িক ভিত্তিতে চাষ হয় ভারতে।
|
উচ্চতা: পাঁচ-ছয় ফুট (পরিণত)। |
ওজন: ২৫-৩০ কেজি (পরিণত)। |
মাংস: কেজি ১ হাজার টাকা। |
ডিম: একটি ৫০০ টাকা। |
|
ফার্ম হাউস সূত্রেই জানা গিয়েছে, শূন্য ডিগ্রি থেকে প্রচন্ড গরমেও এরা অনায়াসে থাকতে পারে। শরীরের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইট। আমেরিকায় খোলা মাঠে ঘুরে বেড়ায়। ভারতীয় আবহাওয়া এদের বসবাসের পক্ষে অনুকূল। অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় পাখি এমু। আমেরিকাতেও প্রচুর পরিমাণে এমু পাখি রয়েছে। সেখানেই প্রথম ব্যবসায়ীক ভিত্তিতে এমু পাখির চাষ হয়। কয়েক বছর পর থেকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে প্রচুর এমু পাখির চাষ শুরু হয়েছে। ফার্ম তৈরি করে এমু পাখির প্রজনন করানো হচ্ছে। তার পর সেগুলি বাইরে বিক্রি করা হচ্ছে। উত্তরবঙ্গ ঘেঁষা নেপাল, ভুটান, সিকিমে এমু পাখির প্রচুর চাহিদা রয়েছে। এমু পাখির মাংস প্রতি কিলোগ্রাম ১ হাজার টাকায় বিক্রি হয় ওই এলাকায়। পরিণত বয়সে প্রতিটি পাখি ২৫ থেকে ৩০ কিলোগ্রাম পর্যন্ত ওজন হয়। একেকটি ডিম ৮০০ গ্রাম হয়। তার দাম ৫০০ টাকা। তা ছাড়াও এমু পাখির চামড়া দিয়ে ব্যাগ জুতো তৈরি হয়। এমু পাখির তেল, পালক ‘কসমেটিক মেডিসিন’ তৈরির কাজে লাগে। নেপাল, ভুটানের বাজারে এর প্রতিটি জিনিসের ভাল চাহিদা রয়েছে। প্রদীপবাবু বলেন, “বিদেশের বাজারে এমু পাখি পাঠাতে বেশ কিছু অনুমতির প্রয়োজন হয়। সেগুলির কাজ বাকি রয়েছে। তা করা হচ্ছে। তার পরেই প্রক্রিয়া মেনে বাইরে পাঠানোর কাজ শুরু করা হবে। এই চাষ সফল হলে অনেক মানুষের উপকার হবে।”
একটি এমু পরিণত বয়সে ৫-৬ ফুট লম্বা হয়। প্রতিদিন একটি পাখি ৫০০ গ্রাম ভুট্টা খায়। এ ছাড়া প্রচুর পরিমাণে জল খায় তারা। তাই এমুর চাষ সফল হলে এলাকায় ভুট্টার চাষও বাড়বে বলে আশা করছেন বাসিন্দারা। কোচবিহার শহরের বাসিন্দা বিল্লোল সরকার এমু পাখি দেখতে যান বড়ুয়া পাড়ায়। তিনি বলেন, “এমু পাখির কথা বেশ কিছু দিন ধরেই শুনছি। চোখে একবার দেখব ভেবেই চলে এসেছি। এ রকম পাখি এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে ভাবতেই অন্যরকম লাগছে।” এলাকার বাসিন্দা কপুরুদ্দিন মিয়া, ভোলা মিয়াঁরা বলেন, “বাইরে থেকে মানুষ এসে জিজ্ঞাস করে এমু পাখিদের গ্রাম কোনটা। আমরা বলি এটাই। তার পর পথ দেখিয়ে দিই তাঁদের।” |