সিডি বিক্রির আকালের জেরে শুধু মিউজিক ওয়র্ল্ড-এর মতো শোরুমই বন্ধ হচ্ছে না, কলকাতার রেকর্ডিং স্টুডিওগুলিতেও তার ভাল রকম প্রভাব পড়ছে। আগামী তিন মাসে শহরের বিভিন্ন স্টুডিওয় নির্ধারিত গানের রেকর্ডিং-এর প্রায় ৫০ শতাংশই বাতিল হয়ে গিয়েছে। ফলে সিডি ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে স্টুডিও কর্ণধার এবং রেকর্ডিং-এর সঙ্গে জড়িত সহ-শিল্পী এবং বাজনদারদের ভবিষ্যৎ প্রশ্নচিহ্নের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।
দক্ষিণ কলকাতার সুপরিচিত এক সিডি ব্যবসায়ী রাখঢাক না করেই বললেন, “বিক্রি যে এতটা কমবে, আমরা ভাবতে পারিনি। পুজোর মরসুম বাদ দিলে প্রতিদিন যেখানে আড়াইশো থেকে তিনশো সিডি অনায়াসে বিক্রি হয়ে যেত, সেটা এখন পঞ্চাশ থেকে ষাটে নেমে দাঁড়িয়েছে।” শুধু বাংলা গান নয়, হিন্দি গানের সিডি বিক্রিতেও একই দশা উত্তর কলকাতার বেশ কয়েকটি দোকানে। “পুজোর আগে শোরুম সাজাব ভেবেছিলাম। কিন্তু বাজার দেখে পিছিয়ে গেছি,” আক্ষেপ সিডি ব্যবসায়ী শৈবাল রায়ের।
পিছিয়ে যাচ্ছেন শিল্পীরাও। বাতিল হচ্ছে রেকর্ডিং। এবং এই প্রবণতা বাড়বে বই কমবে না বলেই আশঙ্কা স্টুডিও মালিকদের। স্টুডিও ‘উৎসবে’র কর্ণধার বলছেন, “অনেক দিন ধরেই বোঝা যাচ্ছিল মন্দা আসছে। এ বার সত্যিই এল। পঞ্চাশ কেন, বাতিলের সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, দেখুন না!” “বাংলাদেশের বেশ কয়েক জন শিল্পীও আপাতত আর রেকর্ডিং এ আসছেন না কলকাতায়,” দাবি করলেন প্রসাদ স্টুডিওর কর্ণধার খোকন প্রসাদ।
কলকাতায় এই মুহূর্তে ৩৮টি ছোট ও মাঝারি স্টুডিও রয়েছে। ক্যালকাটা সিনে মিউজিক মিউজিশিয়ানস অ্যাসোসিয়েশনস বা সিসিএমএ-র দেবাশিস সাহার হিসেব বলছে, এই সব স্টুডিওর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িয়ে আছেন প্রায় তিন হাজার মিউজিশিয়ান। তার সঙ্গে সিডির ইনলে কার্ড ছাপাখানা, চা-ওয়ালা বা ক্যান্টিনওয়ালাদের ধরলে সংখ্যাটা লক্ষাধিক। যে কোনও স্টুডিও ঘিরে এঁদের কর্মব্যস্ততাও প্রায় তিন শিফটেই চালু থাকে। দেবাশিসের কথায়, “নতুন গানের রেকর্ডিং যে ভাবে বাতিল হচ্ছে, তাতে আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াব ঈশ্বর জানেন!”
ইএম বাইপাসের ধারে ‘মিউজিক ২০০০’-এর কর্ণধার স্বরূপ পালের স্টুডিওতে ব্যস্ততা বাড়ে পুজো আসার ছ’মাস আগে থেকেই নতুন গানের রেকর্ডিং-এর জন্য। রবীন্দ্রজয়ন্তীর আগে প্রায় তিন মাস রবীন্দ্রসঙ্গীতের নতুন সিডির জন্য লম্বা লাইন থাকে। স্বরূপ রীতিমতো চিন্তিত, “ব্যবসায় এই পরিমাণ ভাটা গেলে বেশ কিছু মানুষের রুজি রোজগারে টান পড়বে।” পেশার তাগিদে বহু টাকা ঋণ নিয়ে শহরতলিতে সদ্য স্টুডিও খুলেছিলেন অর্ণব রায়। কী ভাবে ভারমুক্ত হবেন, ভেবে পাচ্ছেন না। বলছেন, “আগে বুঝলে এই পথে পা বাড়াতাম না।”
তবে অডিও সেন্টার-১ ও ২-এর কর্ণধার বিশ্বজিৎ প্রসাদ এই বিপর্যয়ে বিস্মিত নন। তাঁর দাবি, অনেক আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল, এমনটা ঘটবে। শুধু পাইরেসি বা নেট থেকে গান ডাউনলোড নয়, শ্রোতারা বিরক্ত হচ্ছিলেন শিল্পীদের খামখেয়ালির জন্যও। “কোন শিল্পী কোন গান গাইলে শ্রোতাদের আগ্রহ বাড়বে, বাজার ঘেঁটে আমরা যথাসময়ে বহু জনপ্রিয় শিল্পীকে জানিয়েছি। কিন্তু ওঁরা গুরুত্ব দেননি।” নিজে স্টুডিও কর্ণধার, সমীর খাসনবিশ তার সঙ্গে সুপ্রতিষ্ঠিত সঙ্গীতায়োজকও। তাঁর কথায়, “বাংলা গানে এত বড় বিপর্যয় শুধু শিল্পী নন, সব কলাকুশলীদেরই ঘোর সংকটে ফেলে দিল।” সঙ্কট কতটা গভীর? সারেগামা-র আঞ্চলিক অধিকর্তা এস এফ করিমের মতে, স্টুডিওর সমস্যাটা সাময়িক। “আমরাও তো সমস্যার বাইরে নয়। আমাদেরও স্টুডিও আছে। তবে এই মুহূর্তে সেখানে অন্য কাজ হবে।” আশাবাদী লোপামুদ্রা মিত্রও। তিনি বিশ্বাস করেন প্রত্যেক পরিবর্তনেই একটা সাময়িক ধাক্কা আসে। “ভাবুন না, ক্যাসেট থেকে যখন সিডি হল, তখন এ রকম একটা ডামাডোল তৈরি হয়েছিল। ‘গেল গেল’ রব উঠেছিল। এ বার সিডি থেকে সরাসরি নেট। এটাও থিতু হবে। তখন ইন্টারনেটে নতুন সব গান ধরাতে স্টুডিওগুলোতেই ভিড় বাড়বে।” কসমিক এর সুমন চট্টোপাধ্যায় বা ইউডি সিরিজের রাজকল্যাণ রায় এখনই তাই বিকল্প রাস্তায় হাঁটতে রাজি নন। তবে রূপঙ্কর বা ব্যান্ডের সুরজিৎ চট্টোপাধ্যায় জোর দিয়ে বলছেন, পাইরেসি ঠেকানোর উপায় খুঁজতেই হবে। নইলে সামনে আরও বড় বিপদ আসছে। |