বছর আটেক আগে ঝাড়গ্রামে একটি ইস্পাত কারখানা গড়েছে কলকাতার এক শিল্পগোষ্ঠী। শিল্প স্থাপনের জন্য সরকারের কাছে উৎসাহ ভাতা (ইনসেনটিভ) বাবদ সংস্থাটির পাওনা প্রায় ১০০ কোটি টাকা। কিন্তু শিল্প আর অর্থ দফতরে ঘুরে ঘুরে জুতোর সুখতলা ছিঁড়ে গেলেও সে টাকা উদ্ধার হয়নি। সরকার এখন বলছে, সংস্থাটির কর্মকাণ্ড নিয়ে সিবিআই-তদন্ত চলছে, তাই উৎসাহ ভাতা দেওয়া যাবে না। সংস্থাটির কর্তৃপক্ষের বক্তব্য “শিল্পে উৎসাহ ভাতা দেওয়ার সঙ্গে তদন্তের কী সম্পর্ক? আমরা আট বছর আগে যখন বিনিয়োগ করেছিলাম, তখন তো কোনও তদন্ত ছিল না!”
ঝাড়গ্রামের এই কারখানা-মালিক একা নন, গত কয়েক বছরে রাজ্যে বিনিয়োগ করা কয়েকশো ছোট-বড় শিল্পপতির একই অভিজ্ঞতা। ২০১১-১২ অর্থবর্ষের শেষে সরকারের কাছে উৎসাহ ভাতা বাবদ লগ্নিকারীদের পাওনা ছিল ৬৮৩ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা। এখন যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা। অর্থ দফতর এই টাকা ঠিক সময়ে দিতে অপারগ। কারণ সরকার জানিয়ে দিয়েছে, প্রতি মাসে ২৫ কোটি টাকার বেশি উৎসাহ ভাতা দিতে পারবে না। ফলে, লগ্নি করে চার-পাঁচ বছর অপেক্ষার পর শিল্পপতিরা বুঝতে পারছেন, উৎসাহ ভাতার টাকা পেতে তাঁদের আরও বছর তিন-চার অপেক্ষা করতে হবে। |
ভাতা-কথা |
• বকেয়া উৎসাহ ভাতা |
৬০৬.৭২ |
• বকেয়া বিদ্যুৎ-ভর্তুকি |
৭৬.৮৪ |
মোট |
৬৮৩.৫৬ |
• মেটানো উৎসাহ ভাতা |
১২৮.৭২ |
• মেটানো বিদ্যুৎ-ভর্তুকি |
৭০.০০ |
মোট |
১৯৮.৭২ |
২০১২ সালের ১ এপ্রিল পর্যন্ত
(* হিসেব কোটি টাকায়) |
|
আর এই বার্তা ছড়িয়ে পড়ায় এ রাজ্যে নতুন বিনিয়োগ টানাও কষ্টকর হবে বলে মনে করছেন শিল্প দফতরের কর্তারা। তাঁদের কথায়, নতুন শিল্পনীতিতেও উৎসাহ ভাতা নিয়ে প্রচুর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তা মেটানোর রেকর্ড এতটাই খারাপ, যে শিল্পপতিরা আর এই প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করতে চাইছেন না।
শিল্পে লগ্নি টানতে চেষ্টার কসুর করছে না শিল্প দফতর। কলকাতা ও হলদিয়ায় দু’দফায় ‘বেঙ্গল লিডস’ সম্মেলন হয়েছে। কলকাতা ও দিল্লিতে দেশের তাবড় শিল্পপতিদের ভোজসভায় ডেকে এ রাজ্যে বিনিয়োগের আর্জি জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুম্বই, বেঙ্গালুরুর মতো শহরে রোড-শো করারও পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু এ রাজ্যে বিনিয়োগ করার পর প্রতিশ্রুতি মতো উৎসাহ ভাতা মেটাতে সরকারের যে আদৌ কোনও উৎসাহ নেই, তা জেনে শিল্প মহল নিরাশ।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের দাবি ছিল, ২০১১ সালের মে মাসের পর থেকে ২৫৭টি শিল্প প্রকল্পে ২ লক্ষ ১২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। কিন্তু সেই বাজেটের সঙ্গে পেশ করা আর্থিক সমীক্ষা জানাচ্ছে, ২০১২-১৩ আর্থিক বছরে রাজ্যে সাকুল্যে ১২টি প্রকল্পে বাস্তবে বিনিয়োগ হয়েছে ৩১২ কোটি টাকা। আগের বছরে এর পরিমাণ ছিল ২৪৬৫ কোটি টাকা। অথচ বামফ্রন্ট সরকার চলে যাওয়ার বছরেও রাজ্যে রূপায়িত প্রকল্পে বিনিয়োগ হয়েছিল ১৫ হাজার ৫২ কোটি টাকার। শিল্পের এই খরা কাটাতেই এই সরকার নতুন শিল্পনীতি ঘোষণা করেছে। তাতেই জানানো হয়েছে, এ রাজ্যে বিনিয়োগ করলে লগ্নিকারীদের মোটা উৎসাহ ভাতা দেওয়া হবে। কিন্তু তাতেও চিঁড়ে ভিজছে বলে মনে করছে না শিল্প দফতর।
বকেয়া উৎসাহ ভাতা নিয়ে শিল্পপতি এবং বিভিন্ন বণিকসভার ক্ষোভের বিষয়ে অবহিত রয়েছেন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “শিল্পপতিদের ক্ষোভ সঙ্গত। সরকারি নীতিতেই তো উৎসাহ ভাতার কথা রয়েছে। তবে মাসে ২০ কোটি টাকার বেশি বকেয়া ভাতা মেটানো হবে না, এই সিদ্ধান্ত বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই নেওয়া। আমরা তা বাড়িয়ে ২৫ কোটি টাকা করেছি।” পার্থবাবুর বক্তব্য, “চেষ্টা করা হচ্ছে বকেয়া ভাতা মেটানোর। শিল্পপতিদের বলেছি, সমস্যা হলে আমার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করুন। তবে ভাতা মেটায় অর্থ দফতর। আমার দফতর ভাতার পরিমাণটা শুধু ঠিক করে দেয়। সে কাজে কোনও বিলম্ব হচ্ছে না।” কেন অর্থ দফতর বকেয়া ভাতা মেটাতে পারছে না, তার ব্যাখ্যা দিতে নারাজ অর্থ দফতর। মন্ত্রী অমিত মিত্রও এ নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি। অর্থ দফতরের এক কর্তা বলেন, “সরকারের নুন আনতে পান্তা ফুরনোর হাল। প্রতি মাসে কর্মীদের বেতন দিতেই ১০০০ কোটি করে ধার করতে হচ্ছে। বকেয়া ৭৫০ কোটি কী ভাবে দেওয়া যাবে? আপাতত প্রতি মাসে ওই ২৫ কোটি উৎসাহ ভাতা মেটানোর ব্যবস্থাই বহাল থাকবে। চাপ পড়লে সেটাও স্থগিত রাখা হবে।” ’১২-’১৩ সালে সরকার উৎসাহ ভাতা খাতে মেটাতে পেরেছে মাত্র ১২৮ কোটি। বিদ্যুৎ-ভর্তুকি বাবদ শিল্প সংস্থাগুলির পাওনা প্রায় ৭৭ কোটি। এক বণিকসভার কর্তা বলেন, “বাউলদের উৎসাহ ভাতা দিতে রাজ্য সরকার যতটা আগ্রহী, লগ্নিকারীদের জন্য ততটা নয়। ফলে বিনিয়োগকারীর পাওনা টাকা সরকারের ঘরে পড়ে থাকাটাই দস্তুর হয়ে উঠেছে।” |