হুল্লোড়
মুন্নাভাইদের সংকট

পয়লা জুলাই, ১৮৮২।
সে দিন জন্ম হয়েছিল ডা. বিধান চন্দ্র রায়-এর।
একশো ন’বছর পর, ১৯৯১ সালে, এই দিনে প্রথম পালিত হয় ডক্টরস ডে।
‘অলীক সুখ’-এ দেবশঙ্কর হালদার
সামনেই মুক্তি পেতে চলেছে নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘অলীক সুখ’। মুখ্য ভূমিকায় দেবশঙ্কর হালদার এবং ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। বলছেন শিবপ্রসাদ, “এক ডাক্তারের জীবন নিয়ে ছবি। কী ভাবে পেশাদার আর ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংঘাত চলতে থাকে, কী ভাবে কাজের চাপে অনেক ক্ষেত্রেই স্ত্রী আর ছেলের জন্য সময় থাকে না।” তবে এ সমস্যা শুধুমাত্র বড় পরদার ডাক্তারদের নয়। বলছেন ঋতুপর্ণা, “সিনেমায় আমি এক ডাক্তারের স্ত্রী। ব্যক্তিগত জীবনে আমার শ্বশুর-শাশুড়ি দু’জনেই ডাক্তার। আমার শাশুড়ি প্রায়ই আমার স্বামীকে বলেন, যে ওকে সময় দেওয়ার জন্যই উনি প্রাইভেট চেম্বার কোনও দিন করেননি।” আমার আজ, জাতীয় ডাক্তার দিবসে চিকিৎসকরা আনন্দplus-কে জানাচ্ছেন কী ভাবে এই সমস্যা মোকাবিলা করেন তাঁরা।

নিজের ছেলের অপারেশনে থাকতে পারিনি

সব ডাক্তারের জীবনেই এ রকম সমস্যা হয়ে থাকে। এবং এখানে সহধর্মিণীদের ভূমিকাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। একবার আমার ছেলের অপারেশনের সময় আমি পৌঁছতে পারিনি। এমার্জেন্সি অপারেশন করতে হয়েছিল। কিন্তু আমি সে সময় অন্য একটা এমার্জেন্সি অ্যাটেন্ড করতে ব্যস্ত। প্রশ্ন নিশ্চয়ই উঠেছিল কেন আমি নিজের ছেলের অপারেশনের সময় পৌঁছতে পারিনি। এ ছাড়া যে কোনও সান্ধ্য অনুষ্ঠানে আমি আর আমার স্ত্রী একসঙ্গে যেতেই পারি না। অনেক ক্ষেত্রে যাওয়াই হয়ে ওঠে না। ডাক্তারি ছাড়াও আমি অন্যান্য অনেক সামাজিক কাজের সঙ্গেও যুক্ত। বহু সময় রাতবিরেত হয় ফিরতে। আমার সহধর্মিণী হয়তো না খেয়ে জেগে বসে থাকেন। আগে এ নিয়ে হয়তো একটুআধটু সমস্যা হত। এখন ও বুঝে গিয়েছে। আর সে জন্য আমি ওর কাছে কৃতজ্ঞ।


(ডা. সুব্রত মৈত্রর স্ত্রী)
এই ঘটনাটা আমাদের জীবনে প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকে। এখন আমাদের বাড়িতে কোনও অনুষ্ঠান আয়োজন করা হলে আমরা ধরেই রাখি যে উনি রাত সাড়ে ন’টার আগে সেখানে আসতে পারবেন না।
ভাগ্যচক্রে আমাদের বেশির ভাগ বন্ধুই ডাক্তার। আর আত্মীয়রা তো বাড়ির মধ্যেই থাকেন। আমার ক্ষেত্রে আরও একটা সুবিধা হল যে, আমার বাবা ছিলেন ডা. বিমলেন্দু মুখোপাধ্যায়। আমি এ রকম জীবনযাত্রাতে অভ্যস্ত ছিলাম। বাবা যখন রাউন্ডে যেতেন, তখন আমি আর আমার ভাইও সঙ্গে যেতাম। তখন হয়তো ক্লাস সেভেন-এ পড়ি। সাড়ে ন’টা নাগাদ আমরা বাবার সঙ্গে যেতাম। কোনও দিন বাবা আইসক্রিম কিনে দিতেন। কোনও দিন হয়তো চাইনিজ।
এক বার আমার ছেলের জন্মদিনে বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান করেছিলাম। কিন্তু ডা. মৈত্র আটকে পড়েছিলেন কাজে। যখন বাড়ি ফেরেন, তখন রাত পৌনে এগারোটা। তবে বাকিদের আমি ব্যাখ্যা দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তবে এটুকু বলি, আমার এ নিয়ে কোনও আক্ষেপ নেই। এই সব নিয়েই তো সাতাশ বছর একসঙ্গে কাটালাম।
বিদেশে এই সব সমস্যা কম

একবার আমার এক রুগি হঠাৎ খুব ক্রিটিকাল হয়ে পড়েন। এমার্জেন্সি অপারেশনের প্রয়োজন। কেসটা এতটাই সিরিয়াস ছিল যে অপারেশনের সময় একজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞেরও প্রয়োজন ছিল। আমি ডা. সৌগত আচার্যকে ফোন করি। ও সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে। আর সঙ্গে নিয়ে আসে ওর স্ত্রী আর ছেলেকে। তখন আমি অপারেশন নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু এটুকু লক্ষ করেছিলাম যে স্ত্রী আর ছেলে বেশ সেজেগুজে এসেছিল। পরে শুনি যে সে দিন ছিল সৌগতর বিবাহবার্ষিকী। আমার ফোনটা যখন ও পায় তখন ওরা পাঁচতারা এক হোটেলে নৈশভোজে ছিল। ফোন পেয়েই হাসপাতালে চলে আসে। আর হোটেলে বলে আসে যে খাবারটা প্যাক করে রাখতে! আজকাল অবশ্য আমার প্রেসক্রিপশনে লেখা থাকে যে আমি সব ক্ষেত্রে পেশেন্টকে নিজে নাও অ্যাটেন্ড করতে পারি। আমার একটি টিম রয়েছে। এবং টিমের যে কোনও সদস্যই রুগিদেরকে দেখতে পারেন। আমার নিজের আত্মীয়দের যদি ওরা অ্যাটেন্ড করতে পারে তা হলে আমার রুগিদের কেন পারবে না? টেলিফোনেও আমি কোনও সাজেসন দিই না। আমাদের দেশের একটা সমস্যা হল আমরা না বলতে শিখিনি। বিদেশে কিন্তু এই সমস্যা নেই। আমার এক বন্ধু বিদেশে ট্রেনিং নিয়ে ইংল্যান্ডে থাকে। তেরো বছরে ওর মোবাইলে একটি মাত্র কল এসেছিল। ওখানকার রোগীরা জানে কেউ অসুস্থ হলে হাসপাতালেই যোগাযোগ করতে হবে। ওখানে চিকিৎসা ব্যবস্থাটা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক। ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়।


(ডা. গৌতম খাস্তগীরের স্ত্রী)
ইংল্যান্ডে থাকতে আমার একবার চিকেন পক্স হয়েছিল। কিছু খেতে পারছিলাম না। বাড়িতে খাবার বলতে ছিল শুধু পাউরুটি। এমনকী দুধটাও প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। মুখের মধ্যে আলসার। কিন্তু আমার স্বামী তখন কাজে ব্যস্ত। একটা গ্র্যান্টের কাজ। এতটাই ব্যস্ত ছিল যে বাড়িতে তিনদিন ফিরতেই পারেনি। একবার আমাদের দিঘা বেড়াতে যাওয়ার কথা। হঠাৎ খবর এল যে একজন পেশেন্টের লেবার পেন শুরু হয়েছে আর ওকে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাটেন্ড করতে হবে। বাড়ির সবার মুখ কাচুমাচু। ও তখন আমাদের সবাইকে রওনা করে দিল গাড়িতে। নিজে চলে গেল অপারেশন করতে। অপারেশন হয়ে যাওয়ার পরে ও বাস ধরে চলে আসে দিঘা। জানত কোন হোটেলে আমরা থাকব। দরজা খুলে ওকে দেখে তো আমরা খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম। কিন্তু একটা কথা বলব, ইংল্যান্ডে কিন্তু সাধারণ মানুষ ডাক্তারদের ব্যক্তিগত সময়টাকে সম্মান করেন। ভুলে যায় যে শুধু নিজস্ব কাজ নয়, মানুষের মাথারও তো একটা ক্ষমতা থাকে। সারা ক্ষণ কাজ করা তো কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।
ছেলের ডেঙ্গু, তার মধ্যেও রুগি দেখেছি

যেহেতু আমার স্বামীও (ডা. অবিনাশ চট্টোপাধ্যায়) ডাক্তার, তাই আমার সমস্যা কম হয়। কিন্তু এ রকম তো অনেক ক্ষেত্রেই হয়েছে যে আমার ছেলের প্রচণ্ড জ্বর, তবু আমাকে রুগি দেখতে যেতেই হয়েছে। ছেলেকে হয়তো রক্ত পরীক্ষা করাতে নিয়ে গিয়েছি। গাড়িতে বসিয়ে রেখে মাঝে রুগি দেখে এসেছি। অনেক সময় রোগীরাও জেনে যায়, পরে আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে ছেলে কেমন আছে। একবার ছেলের ডেঙ্গু হয়েছিল। সারা রাত ধরে আমরা দু’জন জেগে। হঠাৎ শুনি একজন পেশেন্টের লেবার পেন শুরু হয়েছে। আমার স্বামী সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে তাঁকে অ্যাটেন্ড করে। আমি ছেলের কাছে থাকি। পরে আমিও গিয়ে অ্যাটেন্ড করি। বেড়াতে যাওয়া ক্যানসেল হয়েছে কয়েক বার। এমারজেন্সি অ্যাটেন্ড করতে হয়েছে। ছেলে প্রচুর কান্নাকাটি করেছে। ওকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। এখন আমার চেম্বার কমিয়ে দিয়েছি। বুঝি যে ছেলের বয়স যত বাড়ছে ও বেশ ডিমান্ডিং হয়ে যাচ্ছে। মা হয়ে আমিও সেই সময়টা ওকে দিতে চাই। আগে চেম্বারে চল্লিশটা পেশেন্ট সহজেই দেখে ফেলতাম। সন্ধে গড়িয়ে হয়তো রাত দশটাও বেজে যেত। এখন দুপুরে চেম্বার করি আমি। সাড়ে সাতটার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসি।


(ডা. পলি চট্টোপাধ্যায়ের স্বামী)
যেহেতু আমরা যৌথ পরিবারে থাকি, তাই আমাদের সে রকম কোনও সমস্যা হয় না। পেশেন্টরাও কিছু মনে করেন না যদি পলির বদলে আমি কাউকে দেখে দিই। আর সব থেকে বড় ব্যাপার হল, যেহেতু আমি আর ও একই পেশায় রয়েছি, আমি ওর অবস্থাটা ভাল বুঝতে পারি। সেটা না হলে অসুবিধা হত।
বন্ধুরা বলত হয় পেশাটা টিকবে, না হয় বিয়েটা

ডাক্তারদের পক্ষে ব্যক্তিগত জীবন আর পেশাদার জীবনটাকে ব্যালান্স করে চলাটা বড় কঠিন সমস্যা। উই হ্যাভ টু ব্যালান্স লাইফ অন ওয়ান সাইড অ্যান্ড রিলেশনশিপ অন দ্য আদার। আমি নিজে যে ধরনের কাজ করি, সেখানে সময়টা বেশ ডিম্যান্ডিং। কেরিয়ার যখন প্রথম শুরু করি, তখন খানিকটা সময় আমি বিদেশে কাটিয়েছি। শুক্রবার সকালে বাড়ি থেকে বেরোতাম। আর সোমবার রাতে আবার ফিরতাম।
তখন সদ্য বিয়ে করেছি। বিদেশে কোনও সাপোর্ট সিস্টেম নেই। অন্তত দু’বার এ রকম হয়েছে যে, আমি বাড়ি ফিরে এসে দেখেছি যে আমার স্ত্রী-র প্রায় একশোর ওপর জ্বর। দু’দিন ধরে ও তাই নিয়ে পড়ে আছে। আমার ছেলেকেও সামলাচ্ছে। আমি আরও একটা জিনিস করেছিলাম। বিয়ের ঠিক পরেই হার্ট সার্জারি করতে শুরু করি। কারণ হার্ট সার্জারি মানে বেশ ডিম্যান্ডিং একটা কাজ। বন্ধুরা বলত হয় পেশাটা টিকবে, না হয় বিয়েটা।
অন্তত চার বার আমি বেড়াতে যাওয়ার ছুটি ক্যান্সেল করেছি। এক বার তো ইউরোপের ছুটি ক্যান্সেল করেছিলাম বেড়াতে যাওয়ার ঠিক তিন-চার ঘণ্টা আগে। এখন তো আমাদের বাড়িতে এটা স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস হয়ে গিয়েছে যে আমি বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত কেউ ব্যাগ গোছায় না।
ছেলের প্রথম জন্মদিনে বাড়ি ভর্তি লোক। তখন আমার হসপিটালে এমার্জেন্সি এসেছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে চলে গিয়েছি। আমার স্ত্রী আমাকে পঁচিশ বছর ধরে সহ্য করছেন। ফিরে দেখলে মনে হয় এটা অনেকটা ভ্যাকসিনেশনের মতো। এ রকম একটা শিডিউলে ব্যস্ত একজন বাউন্ডুলে মানুষের সঙ্গে থাকতে থাকতে হয়তো ইমিউনিটি তৈরি হয়ে যায়।

(ডা. কুণাল সরকারের স্ত্রী)
খুব যে রেগে গিয়েছি এ নিয়ে, এমনটা কিন্তু নয়। অনেক সময়ই রাতের বেলায় ও চলে গিয়েছে। আমরা বেড়াতে যাব ঠিক হয়েছে। সেজেগুজে রেডি। কিন্তু ও যেতে পারল না। দুঃখ হয়েছে ঠিকই। তবে রাগ নয়। বুঝেছি যে ওর নিজেরও আমাদের ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। তবে পেশেন্টদের প্রতি দায়িত্ব তো ওঁদের থাকবেই। সেই মানসিকতাটা বুঝতে পারি আমি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.