|
|
|
|
অফিসের জাঁতাকলে |
কিউবিকলে বসে অনেক সময়ই নানা চাপের মুখে পড়তে হয়। মন ভারী। খিটখিটে ভাব।
কী করে সব ভুলে চাঙা হবেন? মনোবিদদের সঙ্গে কথা বলে উত্তর খুঁজলেন রেশমী বাগচী
|
মোবাইলে অ্যালার্ম বেজে উঠল। পড়িমরি উঠে আগে সেটা বন্ধ করল শতরূপা। ৭টা বাজে। চোখ আধাখোলা অবস্থাতেই নেমে পড়ল বিছানা থেকে। কিছু দিন ধরেই ও খেয়াল করেছে, ঘুম থেকে উঠেই কেমন মনখারাপ থাকে। কিছুই যেন ভাল লাগে না। মর্নিং সিকনেস হল কি না কে জানে। এই সব ভাবতে ভাবতেই শুরু হল দিন। বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে উঠল। গন্তব্য অফিস। অফিসের কাছাকছি পৌঁছতেই মনটা যেন আরও ভারী হয়ে গেল। শতরূপা বুঝতে পারল, ওর মন খারাপের কারণ কী। প্রতিদিন অফিসের হাজারো সমস্যা, ঝক্কি সামলানো কি চাট্টিখানি কথা! অথচ কোনও উপায়ও তো নেই। শতরূপার মতো আপনারও এ রকম মন খারাপ হয় না কি মাঝে মাঝে? তা হলে এ বার মনকে বলুন, খারাপ থাকার সময় শেষ। মন ভাল রাখার কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গিয়েছে।
|
বড় একা লাগে |
সাধারণত যে সব কারণে মন খারাপ হয়, তার মধ্যে অন্যতম ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বনিবনা না হওয়া। যেমন শুভব্রত, টেলিকম কোম্পানিতে কাজ করেন। বেজায় মেজাজ খারাপ নিয়ে ডেস্কে বসে। অফিসে আজ যা হল, বলার মতো না। এত কাজ ভাল ভাবে সামলেও বসের কাছে বকুনি খেতে হয়েছে। আর যে ভাবে বসের ঘরে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হল, গোটা অফিস সেটা দেখেছে, শুনেছে। অনেক শুভানুধ্যায়ী তো এসে জানতেও চেয়েছে, সিরিয়াস কিছু হয়েছে কি না। শুভব্রত কিছুতেই বুঝতে পারেন না, কেন তাঁর বস তাঁকে পছন্দ করেন না।
মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, বসের বকুনি কিন্তু আপনাকে নয়, আপনার কাজের কোন ত্রুটির কারণে। দু’টোকে গুলিয়ে ফেলবেন না। যদি মনে হয় অযৌক্তিক বকুনি সহ্য করতে হচ্ছে, তা হলে অবশ্যই তাঁকে বোঝাবেন যে আপনি বিষয়টির বিরোধিতা করছেন। তবে চরম উত্তেজনার মুহূর্তে নয়। কিছু সময় পরে, বিনম্র ভাবে, যুক্তি ও দৃঢ়তার সঙ্গে তা ব্যক্ত করুন। মনোবিদ জয়রঞ্জন রাম বললেন, “কী প্রচণ্ড চাপ নিয়ে এখনকার দিনে কাজ করেন সবাই। তাই বছরের ৩৬৫ দিন কারও পক্ষেই একই রকম পারফরম্যান্স রাখা সম্ভব নয়। খুব মন খারাপ হলে, নিজের ডেস্কে এসে বসুন। ডেস্কে সাজানো প্রিয়জনের ছবির দিকে তাকিয়ে বলুন তো, অফিসই কি সব? এর বাইরেও তো আপনার জীবনে কত কিছু আছে! দেখবেন কখন মনখারাপ পালিয়ে গেছে। খুব স্ট্রেসড্ লাগলে, ছোট একটা ব্রেক নিন। হয়তো বাইরে গিয়ে লাঞ্চ করে এলেন বা এক-দু’দিনের জন্য কাছের মানুষদের সঙ্গে কোথাও বেড়িয়েও আসতে পারেন। ভাল লাগবে।”
|
|
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল
|
উপেক্ষা করতে শিখুন |
তনুশ্রী একটু সময়ের জন্য ওঁর কিউবিকল থেকে উঠেছিলেন কফি আনতে। সিটে ফিরতেই খেয়াল করলেন ওঁর অনুপস্থিতিতে কলিগরা নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করছিল। তনুশ্রীকে দেখে আবার যে যার জায়গায়। উনি বেশ কয়েক দিন ধরেই খেয়াল করছিলেন এই ব্যাপারটা। আজকাল ওঁর সঙ্গে খুব একটা কেউ কথাবার্তাও বলছেন না ঠিক মতো। তা হলে কি কলিগরা ওঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন? আরে মশাই, অফিস করবেন, আর অফিস পলিটিক্স সইতে হবে না, তাই হয় নাকি!
মনোবিদ জয়রঞ্জন রাম নিজের অভিজ্ঞতা থেকে একটা বিষয় খেয়াল করেছেন। তাঁর কাছে যাঁরা সাহায্যের জন্য আসেন, উনি তাদের জিজ্ঞেস করেন, ছ’মাস আগের অফিসের এমন কোনও ঘটনা বলতে, যা তাঁকে বিচলিত করেছে। অধিকাংশ সময় কেউ মনেই করে উঠতে পারেন না। ওঁর পরামশর্, সাময়িক ভাবে হয়তো একটু টেনশন হল, কিন্তু তাতে আসলে আপনার কিছুই যায় আসে না। আর ঝামেলা তো সব জায়গাতেই আছে, বেশি পাত্তা না দিলেই হল। একমত অনুত্তমাও। উপেক্ষা করতে জানতে হবে। যদি খুব ডিস্টার্বড লাগে তখন, যে সব কলিগ এই ধরনের আচরণ করছেন, তাঁদের বুঝিয়ে দেওয়া যে আপনি ব্যাপারটা খেয়াল করেছেন। দেখবেন এর পর অন্তত আপনার চোখের সামনে আর ফিসফাস হচ্ছে না। তা ছাড়া, সবাইকে কখনও খুশি করে চলা যায় না। তাই শুধু শুধু নিজেকে ব্যতিব্যস্ত করবেন না।”
|
বাড়ির কথা থাক বাড়িতেই |
অনামিকা যে ভাবে আজ অফিসে ঢুকেছেন, তা একমাত্র উনিই জানেন। বাড়িতে কাজের লোক আসেনি।
এ দিকে শাশুড়ির খুব শরীর খারাপ। ছুটি নিতে পারবেন না কারণ আজ অফিসে খুব জরুরি কাজ আছে। ভেবেছেন অল্প সময়ে কাজ সেরে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাবেন। কিন্তু অনামিকা তো কাজে মনই বসাতে পারছেন না। কাজ শেষ হতে দেরি হলে, শাশুড়িকে ডাক্তারের কাছে কে নিয়ে যাবে? বাড়িকে অফিসে আনবেন না বা অফিস বাড়িতে নিয়ে যাবেন না, কথাগুলো বলা সোজা। কিন্তু করতে পারা ততটাই কঠিন। বাচ্চার রেজাল্ট খারাপ হয়েছে বা স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া, যতই চেষ্টা করুন না কেন, অফিসে এসেও সেই সব সমস্যা আপনার পিছু ছাড়ে না।
এই পরিস্থিতিতে না হয় ঠিক মতো কাজ, না হয় বাড়ি সামলানো, তাই মনোবিদরা মনে করেন অফিসে এসে চারটে ভুল কাজ না করে বরং ছুটি নেওয়া ভাল। আর একান্তই ছুটি না নিতে পারলে, কিছুক্ষণ মোবাইলটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখুন। ক্রাইসিসে পড়লে মানুষ কিছু করতে না পেরে, বারবার বাড়িতে ফোন করে খবর নেয়, তাতে টেনশন আরও বাড়ে। কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হলে, আপনি বাড়ি চলে যেতে পারবেন।
|
ইনক্রিমেন্টের নাগরদোলায় |
অফিস সুদ্ধ আজ সবার খুব টেনশন। অ্যাপ্রাইজাল বলে কথা। গ্রেডেশন ভাল হলে তবেই তো মাইনে ভাল রকম বাড়ার সম্ভাবনা। সম্রাট অফিসে ঢুকেই আগে অ্যাপ্রাইজালের প্রক্রিয়াতে মনোনিবেশ করলেন। ল্যাপটপ খুলে, লগ ইন করে যা দেখলেন তাতে চক্ষু চড়কগাছ। শেষে কিনা ওঁর কাজের এই মূল্যায়ন? খুব হতাশ হয়ে পড়লেন। এ দিকে অফিসের অনেকেই বেশ খুশি খুশি। নিশ্চয় তাঁদের ভাল অ্যাপ্রাইজাল হয়েছে। সম্রাট মনে মনে ঠিক করেছেন, এর একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে, না হলে চাকরিই ছেড়ে দেবেন। খুব চেনা চেনা লাগছে কি ছবিটা? চাকুরিজীবীদের মধ্যে মাইনে ঠিক মতো না বাড়া বা সঠিক মূল্যায়ন না হওয়া নিয়ে অসন্তোষ লেগেই থাকে। কোন পথে সমাধান পাবেন আপনি?
অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় খেয়াল করেছেন, অ্যাপ্রাইজাল বা মাইনে বাড়া নিয়ে অনেক সময় তুলনামূলক বিচারে মন খারাপ হয়। মানে, আপনি এত কাজ করে যা পেলেন, সহকর্মীরা তার অর্ধেক কাজ করেও একই পেল। তাই তুলনা না করে, যা পেয়েছেন, তাতে খুশি থাকার চেষ্টা করুন। জয়রঞ্জন রাম বলছেন, “ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও হয়তো একটু অদলবদল করতে হতে পারে। ভেবেছিলেন বোনাসের টাকা হাতে পেয়ে মরিশাস যাবেন, একটু কাটছাঁট করে না হয় কাশ্মীর ঘুরে এলেন।” কিন্তু চাকরি ছাড়ার মতো হঠকারী সিদ্ধান্ত নেবেন না, পরামর্শ এইচআর কনসালটেন্ট অর্ণা শীলের। উনি বলছেন, “এই মুহূর্তে বিশ্ব জুড়ে এখনও মন্দার প্রভাব রয়েছে। তাই মনের মতো ইনক্রিমেন্ট হওয়া মুশকিল।” একান্তই চাকরি পরিবর্তন করতে চাইলে অর্ণার পরামর্শ, আগে দেখে নিতে হবে যে সংস্থায় যাওয়ার কথা ভাবছেন, সেই কোম্পানি স্থিতিশীল তো? উনি আরও জানালেন, “খুব বেশি জব হপিংও ভাল নয়। এইচআর সব সময় চাকরি দেওয়ার আগে দেখে, কোথায় কত বছর সেই ব্যক্তি চাকরি করেছেন। বারবার চাকরি চেঞ্জ, একজন কর্মীর মাইনাস পয়েন্ট যেন না হয়, সে দিকে খেয়াল রাখুন।” মনখারাপের অব্যর্থ ওষুধ তো সব সময় আপনার সঙ্গেই আছে। দেখবেন আপনি হাসলে, আপনার সঙ্গের পৃথিবীও কেমন হেসে ওঠে। এক দিকে আপনার পরিবার, বন্ধুবান্ধবের ভালবাসা, সাপোর্ট, অন্য দিকে অফিস। মন কি আর অতই অবুঝ যে আপনি কী ভাবে ভাল থাকবেন, তা সে বুঝবে না! তাই তো আজ আপনার মনের ইনবক্স ভরে উঠেছে স্মাইলি-তে।
|
|
|
|
|
|