এসজেডিএ-তে ৫০ কোটির দুর্নীতি |
ধৃত ঠিকাদারের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ |
নিজস্ব সংবাদদাতা • শিলিগুড়ি |
শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এসজেডিএ) প্রায় ৫০ কোটি টাকার দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ধৃত ঠিকাদার শঙ্কর পালকে পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিল আদালত। বৃহস্পতিবার ‘নন্দিনী কনস্ট্রাকশন’ নামে একটি সংস্থার অন্যতম কর্ণধার শঙ্করবাবুকে শিলিগুড়ির হাকিমপাড়ার খেলাঘর মোড়ের বাড়ি থেকে ধরে পুলিশ। শুক্রবার আদালতে হাজির করানো হয় তাঁকে। তাঁর আইনজীবী অভ্রজ্যোতি দাস জামিনের আবেদন করেন। সরকারি আইনজীবী তদন্তের স্বার্থে ধৃতের পুলিশ হেফাজতের আর্জি জানান। বিচারক উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে শঙ্করবাবুর ৭দিন পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দেন। অভ্রজ্যোতিবাবুর দাবি, “জেরার সময়ে আইনজীবী রাখতে পারবেন শঙ্করবাবু। আদালত সেই নির্দেশ দিয়েছে।” |
আদালতে তোলা হচ্ছে ধৃত ঠিকাদার শঙ্কর পালকে। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক। |
পুলিশের দাবি, প্রাথমিক তদন্তে শঙ্করবাবুর বিরুদ্ধে বেশ কিছু তথ্য মিলেছে। এসজেডিএ-এর দুর্নীতি মামলায় একাধিক রাজনৈতিক নেতার নামও উঠে এসেছে। কিন্তু, ওই নেতাদের সঙ্গে ঠিকাদার-ইঞ্জিনিয়রদের যোগসাজশ আদপে কতটা ছিল তা নিয়ে অবশ্য পুলিশ নিশ্চিত হতে পারেননি। তবে পুলিশ সূত্রেই জানা গিয়েছে, শিলিগুড়ি শহরের একজন প্রাক্তন কাউন্সিলর তথা তৃণমূল নেতার ভাই এদিন প্রথমে শিলিগুড়ি আদালতে ও পরে প্রধাননগর থানায় গিয়ে শঙ্করবাবুকে গ্রেফতার করার ব্যাপারে নানা খোঁজখবর নেন। তাতে ওই নেতার ভূমিকা নিয়ে তৃণমূলের অন্দরেও জল্পনা শুরু হয়েছে। শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার কে জয়রমন বলেন,“এসজেডিএর দুর্নীতির মামলায় আমরা নন্দিনী কনস্ট্রাকশনের কর্ণধার শঙ্কর পালকে গ্রেফতার করেছি। তাঁকে জেরা করা হবে।” পুলিশ জানিয়েছে, ধৃতদের জেরা করে সব ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা চলছে।
পুলিশ সূত্রের খবর, এসজেডিএ-এর তরফে যে সব কাজের ৫০ কোটি টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ করা হয়েছে, তার মধ্যে অন্তত ৬ কোটি টাকা শঙ্করবাবুর ব্যক্তিগত ও সংস্থার অ্যাকাউন্টে পাঠানোর প্রমাণ মিলেছে। তার মধ্যে ২০১২ সালের ৩ ডিসেম্বর শঙ্করবাবুর সংস্থার অ্যাকাউন্টে ৩ কোটি টাকার চেক জমা দেয় অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংস্থা। প্রসঙ্গত, অজিতবাবু এসজেডিএ-এর দুর্নীতি মামলার অন্যতম অভিযুক্ত হয়ে ধরা পড়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি বিপুল অঙ্কের টাকার বরাত পেয়ে তা না-করে, যন্ত্রাংশ না-কিনে ভুয়ো নথিপত্র দেখিয়ে টাকা তুলে নিয়েছেন। পরে ২০১৩ সালের ১ এপ্রিল ওই অ্যাকাউন্টেই ফের অজিতবাবুর সংস্থা ২ কোটি টাকার চেক দিয়েছে। তা ছাড়া ২০১২ সালের ৮ ডিসেম্বর শঙ্করবাবুর ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে একই সংস্থা থেকে ১ কোটি টাকার চেক জমা পড়ে। ওই সংস্থাগুলির সঙ্গে কী ধরনের লেনদেন হয়েছে, কার হয়ে শঙ্করবাবু টাকা নিয়েছেন তা নিয়ে পুলিশের কাছে বেশ কিছু স্পষ্ট অভিযোগ পৌঁছেছে।
এসজেডিএ-এর অন্দরের খবর, সংস্থার কোনও ইঞ্জিনিয়র অথবা কর্তার হয়ে শঙ্করবাবু টাকা নিয়েছিলেন কি না তা নিয়েও এসজেডিএ-এর অন্দরে প্রশ্ন রয়েছে। পুলিশের কাছেও বেশ কিছু অভিযোগ পৌঁছেছে। বিশেষত, এসজেডিএ-এর দুর্নীতি মামলায় আগেই ধৃত ইঞ্জিনিয়র মৃগাঙ্কমৌলি সরকারের সঙ্গে শঙ্করবাবুর মধ্যে কোনও লেনদেন ছিল বলে পুলিশের সন্দেহ জোরদার হয়েছে। ঘটনাচক্রে, মৃগাঙ্কবাবু ও শঙ্করবাবুর বাড়ি খুব কাছাকাছি। তা ছাড়া, পুলিশ জানতে পেরেছে, মৃগাঙ্কবাবু হাকিমপাড়ায় যে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, ৩টি গ্যারাজ কিনেছেন, সে গুলি কেনার আগে প্রোমোটার সংস্থার কাছে শঙ্করবাবুই যোগাযোগ করেছিলেন। ওই বিষয়ে প্রোমোটার সংস্থার কাছ থেকেই পুলিশ কিছু তথ্য পেয়েছে বলে দাবি করেছে। এমনকী, ওই বিশাল ফ্ল্যাটটি কম দামে হাতবদলের আড়ালে কোনও রহস্য রয়েছে কি না তা পুলিশ দেখছে।
এ দিকে, এসজেডিএ সূত্রের খবর, ধৃত শঙ্করবাবু এবং নন্দিনী কনস্ট্রাকশন সংস্থার কর্ণধার তারই এক আত্মীয় বুড়া পালের বিরুদ্ধে জোড়াপানি নদী সংস্কারের দুর্নীতিতে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তৎকালীন চেয়ারম্যান রুদ্রনাথ ভট্টাচার্য জানিয়েছিলেন, জোড়াপানি নদী সংস্কারের ওই কাজ তাঁকে অন্ধকারে রেখেই করা হয়েছে। অভিযুক্ত বাস্তুকার মৃগাঙ্কমৌলি সরকারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে তাঁকে জলপাইগুড়িতে বদলি করার নির্দেশ দেওয়া হয় বলেও তিনি জানিয়েছিলেন। বস্তুত, এসজেডিএ’র অধীনে মহানন্দা অ্যাকশন প্ল্যানে নিকাশি তৈরি থেকে জোড়াপানি নদী সংস্কারের মতো বিভিন্ন কাজে যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে তাতে শঙ্করবাবু এবং মৃগাঙ্কবাবুর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে বলেই পুলিশ মনে করছে। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে আদালত চত্বরে দাঁড়িয়ে শঙ্করবাবু বলেন, “যা বলার আদালতে আমার আইনজীবী বলবেন।”
পুলিশের একাংশের সন্দেহ, জোড়াপানি নদী সংস্কার, ত্রিফলা আলো বসানো, মহানন্দা অ্যাকশন প্ল্যানে নিকাশি তৈরিতে ৫ কোটি টাকার পাম্প সরবরাহের মতো অনেক কাজই কোটেশনের মাধ্যমে পছন্দের ঠিকাদার সংস্থাকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসজেডিএ মামলায় ঠিকাদারদের পর পর গ্রেফতার হওয়ার ঘটনায় অস্বস্তিতে শিলিগুড়ি মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন ঠিকাদার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা। সংগঠনের সম্পাদক সজল সরকার বলেন,“আমরা বিব্রত। যা ঘটছে, তাতে ঠিকাদারদের বিশ্বাসযোগ্যতা কমছে। আমরা হতাশ।”
|