আর এক ‘ছেলের’ শেষকৃত্যে সামিল পুত্রহারা দম্পতি
য়পণ্ডা নদীর চরে পাশাপাশি সাজানো দু’টো চিতা। স্বামী-স্ত্রী’র। তখনও আগুন ধরেনি। চারদিকে থিকথিক করছে লোক।
একটু দূরে চোখে পড়ল নদীর পাকা সেতুর কোণে ভিড় থেকে আলাদা কিছুটা জড়োসড়ো ভাবে দাঁড়িয়ে দুই প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া। দু’জনের চোখের কোণেই জল চিকচিক করছে। মৃতেরা আপনাদের কে হন? “আমাদের কেউ হয় না বাবা।” জবাবটা অবাক করল। বাড়ি কোথায়? “রাজগ্রাম।” তা হলে এত দূরে এসেছেন কেন? “অদ্বৈত আর ওর স্ত্রীর অন্ত্যেষ্টি হবে শুনে ছুটে এসেছি। অদ্বৈতর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে মনে হয়েছিল আমাদের ছেলেই মরল! তাই ওর পরিবারের দুঃখের ভাগীদার হতে এলাম।”শাড়ির আঁচলে চোখের জল মুছে বললেন পূরবী কুণ্ডু।
দিলীপ কুণ্ডু ও তাঁর স্ত্রী পূরবী। ২০০২ সালের ৯ এপ্রিল কাশ্মীরের পুলওয়ামায় জঙ্গি হানায় নিহত হন এই দম্পতির বিএসএফ জওয়ান ছেলে সঞ্জীব। আর তাই রাজগ্রাম লাগোয়া পাঁচমুড়ার বাসিন্দা, সেনা-জওয়ান অদ্বৈত নন্দীর সেই কাশ্মীরেই জঙ্গি হামলায় মৃত্যুর খবরটা নাড়িয়ে দিয়েছে সঞ্জীবের বাবা-মাকে। ওই দম্পতির কথায়, “এরা সবাই তো আমাদেরই সন্তান। সব জায়গায় যেতে পারব না। তবে, বাঁকুড়ার বাসিন্দা কোনও জওয়ানের মৃত্যুর খবর পেলে, তার শেষকৃত্যে থাকার চেষ্টা করি।”
অদ্বৈত ও পিউয়ের শেষকৃত্য। পাথরি গ্রামের শ্মশানঘাটে। —নিজস্ব চিত্র
আট বছর আগে সেই টানেই ছুটে গিয়েছিলেন কোতুলপুরের বাঘরোল গ্রামে। ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে ওই গ্রামের বাসিন্দা, বিএসএফ জওয়ান রণজিৎ আচার্য কাশ্মীরের রজৌরিতে জঙ্গিদের গ্রেনেড হামলায় মারা গিয়েছিলেন।
সব শুনে মনে হল, কোথায় যেন মিলে গিয়েছে অদ্বৈতর পরিবারের শোক আর পুত্রহারা এই বাবা-মায়ের দুঃখ। কেউ কাউকে চেনেন না। অথচ এক জওয়ানের পরিবারের শোক ভাগ করতে ছুটে এসেছেন আর এক নিহত জওয়ানের বাবা-মা। যাঁরা বলছেন, “সন্তান হারানোর কী দুঃখ, বাবা-মা ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। আজ অদ্বৈত বা পিউয়ের বাবা-মায়ের উপর দিয়ে কী যাচ্ছে, তা বুঝতে পারছি।”
সোমবার বিকেলে শ্রীনগরের কাছে জঙ্গি হানায় মারা যান তালড্যাংরার পাঁচমুড়ার বাসিন্দা, ‘রাষ্ট্রীয় রাইফেলস’-এর জওয়ান অদ্বৈত নন্দী। মঙ্গলবার রাতে শ্বশুরবাড়িতে আত্মঘাতী হন অদ্বৈতর কলেজ ছাত্রী স্ত্রী পিউ নন্দী। তখনই ঠিক হয়, স্বামী-স্ত্রীকে পাশাপাশি চিতায় দাহ করা হবে।
এ দিন বিকেল পৌনে ৫টা নাগাদ অদ্বৈতের মরদেহ পাথরি গ্রামে (এখানেই অদ্বৈতদের আদি বাড়ি) জয়পণ্ডা নদীর ধারের শ্মশানঘাটে নিয়ে আসে সেনাবাহিনী। তার ঘণ্টাদুয়েক আগেই পৌঁছেছে পিউয়ের দেহ। কফিন থেকে অদ্বৈতর দেহ নামিয়ে ‘গার্ড অফ অনার’ দেয় সেনাবাহিনী। ছিলেন বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার, জেলার মন্ত্রী শ্যামাপদ মুখোপাধ্যায় এবং বিএসএফের পদস্থ আধিকারিকেরা। সেতু এবং নদীর চরে তখন ভিড় করেছেন কয়েক হাজার গ্রামবাসী। পাঁচমুড়া, পাথরি-সহ বহু গ্রাম থেকে লোকে মোটরবাইক, সাইকেল বা হেঁটে নদীর ধারে এসেছিলেন। পাথরি গ্রামের বৃদ্ধা সুবর্ণ মল্ল বলছিলেন, “গত বছর আমার বাড়িতে মনসাপুজোয় এসে আমাকে মোবাইল ফোন উপহার দিয়ে অদ্বৈত বলেছিল, মাঝেমাঝে ফোন করব তোমাকে।” পাঁচমুড়ার অশোককুমার দে বললেন, “অদ্বৈতর বাড়ির পাশেই আমার সব্জির দোকান। ও আমাকে মজা করে টম্যাটো কাকু বলে ডাকত। আর কেউ কখনও আমাকে ওই নামে ডাকবে না।” দুই পরিবারের কেউই এ দিন কথা বলার অবস্থায় ছিলেন না।
কাঁটায় কাঁটায় ৫টা ৪৭ মিনিটে দুই চিতায় আগুন দেওয়া হল। ধোঁয়ায় ঢাকল আকাশ। কান্নার রোলে ভারী হয়ে এল চারপাশ। জয়পণ্ডার উপরে তখন মেঘ জমেছে।

পুরনো খবর



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.