রাজ্যের পঞ্চায়েত ভোট সংকট হয়তো কোনও না কোনও দিন মিটিবে। সুপ্রিম কোর্টের অঙ্গনে যখন বিষয়টি প্রেরিত হইয়াছে, সেই মীমাংসা হয়তো বা খুব বেশি দূরবর্তী না-ও হইতে পারে। কিন্তু এই সমগ্র পর্বে বিতর্ক ও বিচার যে পথে চলিল, যে অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি উদ্ভূত হইল, যে ধরনের পদ্ধতিতে মামলাটি বিবেচনা করা হইল, তাহা কোনও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষেই মঙ্গলজনক হইতে পারে না। অদূরে বা সুদূরে, এই সমস্যা-অঙ্কুরের ফসল রাজ্যকে বহন করিতে হইবে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের কর্মকাণ্ড পরিচালনার অধিকার কাহার, রাজ্য সরকারের না কি রাজ্যের নির্বাচন কমিশনের, এই প্রশ্ন একটি মৌলিক সাংবিধানিক প্রশ্ন। অথচ বার বার সেই মৌলিক প্রশ্নটির পাশ কাটাইয়া তুচ্ছ পদ্ধতিগত খুঁটিনাটিতে বিচারপতিদের মনোযোগ আবদ্ধ হইয়া রহিল বিচারবিভাগের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রাখিয়াও বলিতেই হয়, ইহা অতীব দুর্ভাগ্যজনক। এ দেশে বিচারবিভাগের অতিসক্রিয়তা লইয়া এই সম্পাদকীয় স্তম্ভ বহু বার আপত্তি প্রকাশ করিয়াছে। এ বারের পঞ্চায়েত নির্বাচন বিতর্কের সূত্রে তাহার একটি ভিন্ন মাত্রা রচিত হইল না কি?
এ ধরনের আইনি বিতর্কের ক্ষেত্রে, বিচারবিভাগের কাজ, মূল আইনে যে আদর্শ ব্যক্ত হইয়াছে, সেই আদর্শটিকেই গ্রহণ করা ও তাহার আলোকে পরবর্তী ধারাগুলি বিবেচনা করা। অর্থাৎ বিচারের দৃষ্টিভঙ্গি হইতে, ইহা কোনও নীতি বা রীতির প্রশ্ন নহে, প্রথমত ও শেষত আইনের প্রশ্ন, আইনি আদর্শের প্রশ্ন। ভারতের সংবিধান এক দিন গণতান্ত্রিক নির্বাচনের নিরপেক্ষতা বজায় রাখিবার জন্য কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের আওতা হইতে নির্বাচন পদ্ধতিকে মুক্তি দেওয়া জরুরি বোধ করিয়াছিল, এবং সেই বোধ হইতে জন্ম লইয়াছিল নির্বাচন কমিশনের মতো স্বয়ংসিদ্ধ প্রতিষ্ঠান। নির্বাচন-সংক্রান্ত যে কোনও বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সরকারের উপরে এই কমিশনের স্থান। অন্যথা কমিশন থাকিবার কোনও প্রয়োজনই নাই, ইহাই তাহার অস্তিত্বের ভরকেন্দ্র। তাহার নিরঙ্কুশ অধিকার গণতন্ত্রের বৃহত্তর প্রেক্ষিতেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রসঙ্গত, স্বাস্থ্যবান গণতন্ত্রের শর্ত হিসাবে বিচারবিভাগের স্বাধীনতা মহামূল্যবান, সত্তরের দশকে বিচারবিভাগকে প্রশাসনের বশীভূত করিবার অপপ্রয়াস যে স্বাধীনতার গুরুত্ব চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিয়াছিল। একই ভাবে, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা তথা স্ব-ক্ষমতার গুরুত্বও ভারতীয় নাগরিকরা অভিজ্ঞতার মূল্যে উপলব্ধি করিয়াছেন। সেই গুরুত্ব রাজ্য নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও এক বিন্দু কম হইবার কোনও কারণ নাই। মহামান্য কলিকাতা হাইকোর্ট এই সুস্পষ্ট এবং স্বাভাবিক আদর্শটি কেন দ্ব্যর্থহীন ভাবে প্রতিষ্ঠা করিলেন না? প্রশ্নটি আরও বেশি করিয়া পীড়া দেয়, কারণ রাজ্য নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতার আদর্শটি ইতিপূর্বে একাধিক বার সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে সুনির্দিষ্ট করা হইয়াছে। মধ্যপ্রদেশ বা গুজরাতের মতো রাজ্যে রাজ্য কমিশনের অধিকার-সংক্রান্ত বিতর্কে সুপ্রিম কোর্ট এই আদর্শের অনুসরণেই মীমাংসা-সূত্র দিয়াছে, যে সূত্রগুলি আজ পৃথক ভাবে আইনের সমান মর্যাদা পাইবার যোগ্য। অথচ পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত-মামলার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত খুঁটিনাটিতে বিচারবিভাগের সময় ও শ্রম নিয়মিত ভাবে ক্ষয় হইল। কয়টি পর্বে নির্বাচন সমাধা হইবে, কত পরিমাণ বাহিনী লাগিবে, কোন পক্ষ সেই বাহিনীর দায়িত্বে থাকিবে, এগুলি কি আদালতের বিচার্য? দুই পক্ষের ‘কনসেন্ট’ বা সম্মতির লিখিত প্রমাণ ছাড়াই সেই সম্মতির কথাটি আদালতের নির্দেশে অন্তর্ভুক্ত করাও কি বিধেয় ছিল? আদালতের প্রকাশ্য ঘোষণা শ্রবণযোগ্য ছিল কি ছিল না সেই প্রশ্নে বিচারবিভাগের জড়িত হওয়া কি তাহার নিজের পক্ষেও সম্মানজনক? বিচারালয়ের মর্যাদা অত্যন্ত মূল্যবান বলিয়াই আরও বেশি আশঙ্কা হয়, এই রাজ্যে অন্যান্য ক্ষেত্রে যে সংকীর্ণতার প্রাত্যহিক কর্ষণ, আদালত-চত্বরেও কার্যত তাহারই প্রতিফলন ঘটিল না তো? শাসন-সম্বন্ধীয় কোনও সংকট উপস্থিত হইলে বিচারবিভাগের করণীয়টি ঠিক কী, কোথায় ও কতখানি: এই প্রশ্ন লইয়া গোটা দেশেই ফিরিয়া ভাবিবার সময় আসিয়াছে। তবে পশ্চিমবঙ্গ এ বার দেখাইয়া দিল, এই রাজ্যের পক্ষে প্রশ্নটি কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। |