ভূস্বর্গে মেলবন্ধনের রেলে মনমোহন-সনিয়া
মেলাবে পিরপাঞ্জাল সুড়ঙ্গপথের রেল!
বানিহালে জওহর সুড়ঙ্গপথ বন্ধ হয়ে যায় প্রতি শীতেই। ক’দিনের জন্য ভূস্বর্গ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বাকি দেশ থেকে। কাজিগুন্দ থেকে বানিহাল পর্যন্ত নতুন রেল লাইন সেই বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার দিনগুলি এ বার মুছে ফেলবে কাশ্মীর উপত্যকার ক্যালেন্ডার থেকে। শুধু তা-ই নয় আফজল গুরুর ফাঁসির জেরে কাশ্মীরবাসীর একাংশের মনে কিছুটা বিচ্ছিন্নতার বোধ তৈরি হয়ে থাকলে, তা-ও দূর করবে এই নতুন রেল-সংযোগ। এমন আশা নিয়েই কাশ্মীর সফরের দ্বিতীয় দিনে আজ কাজিগুন্দ-বানিহাল ১৭ কিলোমিটার রেল লাইনের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী। উপত্যকাবাসীর পাশে থাকার বার্তা দিলেন ইউপিএ-র চেয়ারপার্সন সনিয়া গাঁধী। তৃপ্তির হাসি মেলবন্ধনের নেপথ্য কারিগর তিন বঙ্গসন্তানের মুখে। দুর্গম হিমালয়ে এই রেললাইন এঁকে দেওয়ার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছেন এঁরা। দেবপ্রিয় চৌধুরী, শান্তনু চক্রবর্তী ও বীরেন সাহা।
আফজল গুরুর ফাঁসির পরে প্রথম বার কাশ্মীরে এলেন মনমোহন-সনিয়া। বার্তা দিলেন, গত পরশুর শ্রীনগরে সেনা-জঙ্গি সংঘর্ষ বিক্ষিপ্ত ঘটনা। অশান্ত উপদ্রুত কাশ্মীরে শান্তি ফিরিয়ে এনে সার্বিক উন্নয়ন ঘটাতে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাকে পাশে বসিয়ে রাজ্যে জোট সরকারের কাজের প্রশংসা করে রেল লাইন উদ্বোধনের অনুষ্ঠানেই যেন উপত্যকায় লোকসভা নির্বাচনের বিউগল বাজিয়ে দিলেন কংগ্রেস নেতৃত্ব।
কাশ্মীরবাসীর সামনে উন্নয়নের স্বপ্ন তুলে ধরে সনিয়া এ দিন বলেন, “সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত নির্বাচনে যে ভাবে মানুষ এগিয়ে এসেছেন তাতে স্পষ্ট উপত্যকার মানুষ হিংসা দেখে দেখে ক্লান্ত। তাঁরা উন্নয়ন চান। ন্যাশনাল কনফারেন্স ও কংগ্রেসের যৌথ সরকার রাজ্যের মানুষের কাছে উন্নয়ন পৌঁছে দিতে বদ্ধপরিকর।”
নতুন ট্রেনে সওয়ার প্রধানমন্ত্রী ও সনিয়া। ছবি: পিটিআই।
আজ বানিহাল থেকে কাজিগুন্দের মধ্যে লাইনের উদ্বোধন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জম্মু থেকে কাশ্মীরে প্রবেশের দ্বিতীয় রাস্তা খুলে গেল। প্রধানমন্ত্রীর দাবি, জাতীয় প্রকল্পটির অর্ধেক কাজ সারা। নতুন এই রেলপথ সুগম করবে জম্মু-কাশ্মীরের উন্নয়ন ও আর্থিক স্বাবলম্বনের পথ। রেলের চাকা শুধু ভূগোলের দূরত্ব নয়, ঘোচাবে মানসিক ব্যবধানও।
আজ সকালে বানিহাল স্টেশন থেকে ট্রেনকে সবুজ সঙ্কেত দেখানোর কথা ছিল মনমোহন-সনিয়ার। কিন্তু ঝান্ডাা দেখিয়ে যাত্রা শুরু করিয়েই দায়িত্ব সারেননি তাঁরা। সবাইকে অবাক করে দু’জনেই চেপে বসেন ট্রেনে। বানিহাল বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সঙ্গে গল্প করতে করতে বানিহাল থেকে পৌঁছে যান কাজিগুন্দ। সেই ট্রেনেই ফিরে আসেন দু’জনে। প্রধানমন্ত্রী বা সনিয়া এর আগে একাধিক বার কাশ্মীরে এসেছেন বিভিন্ন রেল প্রকল্পের উদ্বোধনে। কিন্তু আম কাশ্মীরির সঙ্গে তাঁদের এ ভাবে মিশে যেতে কি দেখা গিয়েছে আগে! লোকসভা ভোট বছরখানেকের মধ্যেই। ফলে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি আন্তরিকতা ও ঘনিষ্ঠতার এই ছবি নিঃসন্দেহে এক স্পষ্ট রাজনৈতিক বার্তা।
এই মেলবন্ধন, বাকি দেশের সঙ্গে ভূস্বর্গের ঘনিষ্ঠতার স্বপ্নটা দেখেছিলেন কাশ্মীরের মহারাজা প্রতাপ সিংহ। ১৮৯৮ সালে। একশো বছরের বেশি সময় পরে ইউপিএ সরকারের আমলে ২০০৫ সালে প্রথম জম্মু-উধমপুরের মধ্যে ট্রেন চলাচল শুরু করে। এর পর ধীরে ধীরে বারামুলা থেকে অনন্তনাগ ও ২০০৯-এ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন অনন্তনাগ থেকে কাজিগুন্দ পর্যন্ত পৌঁছে যায় রেলের চাকা।
আজ কাজিগুন্দ থেকে বানিহাল অংশের উদ্বোধন করার পর রেল মন্ত্রক জানিয়েছে, উধমপুর থেকে কাটরা অংশের কাজ শেষ হয়ে যাবে আগামী অগস্টে। বাকি থাকবে মাত্র ১৩৫ কিমি লাইনের কাজ। যদিও গোটা প্রকল্পের মধ্যে সব থেকে কঠিন অংশ সেটাই। যা শেষ করতে পাঁচ-ছয় বছর লাগবে বলে জানালেন কাজিগুন্দ থেকে ধরম অংশের দায়িত্বে থাকা ইরকনের অধিকর্তা দেবপ্রিয় চৌধুরী। বানিহালে দাঁড়িয়েই প্রধানমন্ত্রী আজ রেল কর্তাদের নির্দেশ দিয়ে যান, কাজ শেষ করতে হবে দ্রুত। সেই প্রসঙ্গে দেবপ্রিয়বাবুর বক্তব্য, “এখন তিনটে সুড়ঙ্গে দিনে ১০ মিটার করে কাজ এগোচ্ছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ২০ মিটার করে কাজ হবে।”
পিরপাঞ্জাল সুড়ঙ্গ
• বানিহাল থেকে কাজিগুন্দ ১৭ কিমি। তার ১১.২১৫ কিমি জুড়ে পিরপাঞ্জাল সুড়ঙ্গ।
• জহওর সুড়ঙ্গের প্রায় ৫০০ মিটার নীচ দিয়ে ভেদ করেছে পিরপাঞ্জালকে।
• অত্যাধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ৬০ মিটার অন্তর সিসিটিভি, ফায়ার অ্যালার্ম, স্মোক ডিটেক্টর।
• কংক্রিটের উপরে লাইন। সামলে নিতে পারবে বিস্ফোরণের ধাক্কাও।
• লাইনের পাশে ৩ মিটার চওড়া সড়ক। আপৎকালীন পরিস্থিতির জন্য।
• ১৩০০ শ্রমিক ও ১৫০ জন ইঞ্জিনিয়ার মিলে তৈরি করেছেন ৭ বছরে।
• খরচ প্রায় ১৩০০ কোটি টাকা।
আজ যে লাইনের উদ্বোধন হল, পিরপাঞ্জাল সুড়ঙ্গ তার অন্যতম আকর্ষণ। এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ও ভারতের সব থেকে দীর্ঘ ১১.২১৫ কিমি লম্বা এই সুড়ঙ্গ তৈরি হয়েছে জহওরলাল টানেলের প্রায় পাঁচশো মিটার নীচ দিয়ে। দেবপ্রিয়বাবুর দাবি, “এই রেল-সুড়ঙ্গ সারা বছর খোলা থাকবে। এর ফলে কাশ্মীরে প্রবেশের বিকল্প রাস্তা খুলে গেল।” দেবপ্রিয়বাবুর সঙ্গেই ওই সুড়ঙ্গ নির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন শান্তনু চক্রবর্তী। সুড়ঙ্গে লাইন পাতার দায়িত্বে ছিলেন বীরেন সাহা।
রেল লাইন উদ্বোধনের অনুষ্ঠান থেকে আজ আরও এক বার বার্তা গেল প্রতিবেশী পাকিস্তান ও চিনের উদ্দেশেও। তা হল, কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বিচ্ছিন্নতাকামী, জঙ্গি তথা কট্টরপন্থীদের প্রতি সনিয়ার বার্তা, “আলোচনার মাধ্যমেই যে কোনও সমস্যার সমাধান হতে পারে। হিংসার মাধ্যমে নয়।” গত আড়াই দশক ধরে কাশ্মীরে অশান্তি জিইয়ে রাখার মূল কারিগর পাকিস্তান। চিনও যে ভাবে সীমান্ত বরাবর পরিকাঠমো গড়ার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, ভূস্বর্গে এই রেলপথ তারই ভারতীয় জবাব। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের পরামর্শে রেল মন্ত্রক যথাসম্ভব দ্রুত কাশ্মীরের বুক চিরে ওই লাইন পাতার কাজ চালাচ্ছে। এই কাজ শেষ হলে সীমান্তে সেনা-রসদ পৌঁছে দেওয়া যাবে অনেক সহজে। পিরপাঞ্জাল সুড়ঙ্গ দিয়ে শুধু ট্রেনই নয়, পাশে তিন মিটার চওড়া সড়ক দিয়ে প্রয়োজনে সেনার ট্যাঙ্কও অনায়াসে চলে যেতে পারবে বলে জানিয়েছে রেল মন্ত্রক।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.