টালবাহানায় পঞ্চায়েত ভোট, চিৎপুরে লাগল চোট!
না, এটা কোনও যাত্রাপালার নাম নয়। তবে চিৎপুরের যাত্রাশিল্পের সঙ্গে জড়িতদের অনেকেই এখন উদ্বেগ-আশঙ্কায় এমন ছড়াই কাটছেন!
কেন?
কারণ, রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটের ভবিষ্যতের সঙ্গে চিৎপুরের যাত্রাপাড়ার ভাগ্যও জুড়ে রয়েছে।
কী ভাবে?
কারণ, সাধারণত যাত্রাপালার বায়না যাঁরা করেন, সেই নায়েকরা এ বছর পঞ্চায়েত ভোটের তোড়জোড়ে ব্যস্ত। ভোটের পালা না মিটলে যাত্রার পালা জমবে না। যাত্রা দলের মালিকদের অনেকেরই হা-হুতাশ, গত পয়লা বৈশাখের পর থেকে আজ পর্যন্ত অধিকাংশ যাত্রাপালার বায়নাই হয়নি! অথচ নতুন পালার বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে মহলার জন্য আগাম খরচ হচ্ছে। বায়না শুরু না হলে সেই খরচের টাকা শেষ পর্যন্ত উঠবে কি না, সংশয়ে রয়েছেন মালিকেরা।
চিৎপুরে তিনটি যাত্রা দলের মালিক ও ‘পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা সম্মেলন’-এর প্রাক্তন সম্পাদক সমীর সেনের কথায়, “অন্যান্য বার পয়লা বৈশাখ থেকে রথ পর্যন্ত অন্তত ৩০% বায়না হয়ে যায়। এ বার আমাদের অধিকাংশ দলের কোনও বায়নাই হয়নি। কারণ গ্রামাঞ্চল থেকে যাঁরা বায়না করাতে আসেন, সেই নায়েকদের অনেকেই কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত। কে আসবেন বায়না করতে?” চিৎপুরের আর এক যাত্রা প্রযোজক অশোক দাসেরও বক্তব্য, “যাত্রা তো গ্রামভিত্তিক শিল্প। সেই গ্রামাঞ্চলেই ভোট নিয়ে একটা অস্থিরতা রয়েছে। বায়না করা দূরে থাক, এ বার কী পালা করছি, তার খোঁজ নিতেও নায়েকদের দেখা মিলছে না।” |
সাধারণত নববর্ষ থেকে রথ পর্যন্ত বায়না বাবদ গড়পড়তা ৫-১০ লাখ টাকা প্রযোজক বা মালিকের ঘরে জমা পড়ে যায়। কিন্তু এ বার অধিকাংশ দলের ভাঁড়ে মা ভবানী! যাত্রা কোম্পানির মালিকরা বলেছেন, যাত্রার মরসুম শুরু হয় পুজো থেকে। কিন্তু তার জন্য এখন থেকেই শুরু করে দিতে হয় প্রচার। তার জন্য মোটা টাকা খরচ আছে। তার পরে মহলার জন্য বাড়ি ‘বুকিং’ করতে অগ্রিম দিতে হচ্ছে। মহলার খরচও আছে। আগাম বায়না না-মেলায় পকেট থেকে খরচ করতে হচ্ছে দলগুলোকে। খরচের বহরও তো কম নয়। এক প্রযোজক জানাচ্ছেন, বাড়ি ভাড়া বাবদ দিতে হয় ৭০-৮০ হাজার। মোট ভাড়ার ৫০% আগাম দিতে হয়। নামী-দামি শিল্পী থেকে পালাকারদেরও আগাম দিতে হচ্ছে। এ সবের পিছনে খরচ আছে। তার পরে অগস্ট থেকে মহলা শুরু হবে। দল অনুসারে খরচের তারতম্য হয়। তবে প্রতিদিন গড়পড়তা ৭-১০ হাজার টাকা খরচ হয়ই।
আপাতত এখন রথের দিকে তাকিয়ে আছে চিৎপুর। ওই দিন কিছু বায়না মিলবে বলে মনে করছেন তাঁরা। এ আশা অমূলক যে নয়, লালগড়ের নায়েক মৃত্যুঞ্জয় রায়ের কথাতেই তার প্রমাণ। মৃত্যুঞ্জয়বাবু জানাচ্ছেন, এ বারও তাঁরা রথের দিন কলকাতায় যাবেন। বায়না করবেন। পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা সম্মেলনের বর্তমান সম্পাদক কনক ভট্টাচার্যের পর্যবেক্ষণ, “গত কয়েক বছর ধরে দেখছি, রথের আগে পর্যন্ত বায়নার হাল ভাল থাকে না। রথের দিন থেকেই নায়েকদের ভিড় লেগে যায় যাত্রাদলের দফতরে।” কিন্তু এ বার তো পরিস্থিতি আলাদা। পূর্ব ঘোষণা মতো পঞ্চায়েতের তৃতীয় দফার ভোট হওয়ার কথা ৯ জুলাই। পরের দিন রথ। ১৩ জুলাই ফল ঘোষণা। ফলে রথের বাজারও কেমন যাবে, তা নিয়ে সংশয় আছে কনকবাবুদের। তাঁর মন্তব্য, “জুলাইয়ের পরে ভোট হলে আমাদের সর্বনাশ! পুজোর পর থেকে যাত্রার যে মরসুম শুরু হয়, সেটা মার খেয়ে যাবে।” যাত্রা শিল্পীদের সংগঠন ‘যাত্রা প্রহরী’র সম্পাদিকা, অভিনেত্রী ও পালা-নির্দেশক রুমা দাশগুপ্তও বলেন, “পঞ্চায়েত ভোট যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ হওয়া দরকার। না হলে আমরা শেষ হয়ে যাব!”
ভোটের বাজারের অনিশ্চয়তার মধ্যে বাড়তি কাঁটা বর্ধিত পারমিশন ফি। ভোটের ব্যস্ততার মধ্যেই বর্ধমানের রায়নার অশোক নন্দী জানালেন, এ বার তাঁরা যাত্রার আয়োজন করছেন না। তৃণমূলের কর্মী ও নায়েক অশোক বলেন, “কী করে পালা আনব? গত বারের লোকসানের ধাক্কা এখনও সামলে উঠতে পারিনি।” প্রশাসন আচমকা ‘পারমিশন ফি’ বাড়িয়ে দেওয়াতেই তাঁদের লোকসানে পড়তে হয়েছে বলে তাঁর অভিযোগ।
চিৎপুরের বিভিন্ন নায়েকদের বক্তব্য, যাত্রা করাতে গেলে পুলিশ ও অন্যান্য নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য প্রশাসনকে একটা ‘ফি’ তাঁদের দিতে হয়। ২০১১ পর্যন্ত সেটা দু’হাজার টাকার মধ্যে হয়ে যেত। গত বছর থেকে তা বেড়ে ২৫-৩০ হাজার টাকা হয়েছে। অনেক নায়েকের পক্ষেই এই বর্ধিত টাকা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কনকবাবু অবশ্য জানিয়েছেন, ‘পারমিশন ফি’ কমানোর জন্য তাঁরা প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করছেন। সমস্যা মিটবে বলেই তাঁর আশা।
কিন্তু আসল দুশ্চিন্তা তো অন্য জায়গায়। সিরাজ সেজে যাত্রাপাড়া বসে আছে। ভাগ্য এখনও মিরজাফর! কারণ সেই পঞ্চায়েত-জট! |