তারাবাজি
|
ফালতু মানে বিনোদন নয়, বুদ্ধিদীপ্ত মানেই বোরিং নয় |
যাত্রা শুরু করেছিলেন সাস-বহু ধারাবাহিক লিখে। আর তাঁর ছবি ‘শিপ অব থেসিয়াস’ দেখে মুগ্ধ কিরণ রাও থেকে
শেখর কপূর, অনুরাগ কাশ্যপ থেকে কর্ণ জোহর। পরিচালক আনন্দ গাঁধীর সঙ্গে কথোপকথনে প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত |
আনন্দ গাঁধীর মধ্যে কি দ্বৈতসত্তা রয়েছে? আনন্দ ১, যিনি ‘কিঁউকি সাস ভি কভি বহু থি’র সংলাপ লিখতেন আর আনন্দ ২, যিনি ‘শিপ অব থেসিয়াস’য়ের পরিচালক?
(হা হা) আনন্দ ১ ছিলাম যখন আমার বয়স ছিল উনিশ। আনন্দ ১ ওয়াজ দ্য ফাদার অব আনন্দ ২। কথায় আছে না ‘উই আর দ্য চিলড্রেন অব আওয়ার পাস্ট’? অল্প বয়সে ‘কিঁউকি...’র বিরাশিটা এপিসোডের জন্য সংলাপ লিখি। ‘কহানি ঘর ঘর কি’র চিত্রনাট্যটা আমার লেখা। কিন্তু বারবার এই রেফারেন্সটা কেন? আমি তো বহু নাটক লিখেছি। তিরিশ মিনিটের একটা ছবি বানিয়েছিলাম। নাম ‘রাইট হিয়ার রাইট নাও’। তার পর বানিয়েছিলাম ‘কনটিনাম’। অনেক ইন্টারেস্টিং মুভমেন্টের সঙ্গেও আমি যুক্ত ছিলাম। অভয় মেহতার সঙ্গেও আমি কাজ করেছি। অভয় ম্যাসাচুসেট ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (এমআইটি) থেকে পড়াশুনো করেছেন। নিজে এনরন-ধাবল পাওয়ার প্রজেক্টের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। এই সব করা সত্ত্বেও আজও সেই সিরিয়াল লেখার কথা ওঠে!
আচ্ছা, আড়ালে যে আনন্দ রয়েছেন তাঁর সঙ্গে আলাপ করাবেন?
আমি ফার্স্ট ইয়ার কলেজ ড্রপআউট। কমার্সের ছাত্র ছিলাম। যদিও আমার টানটা ছিল বিজ্ঞানের প্রতি। কিন্তু কমার্স নিয়ে পড়তে ঢুকেছিলাম কারণ আমাদের কলেজে ভাল থিয়েটার চর্চা করা হত।
থিয়েটার চর্চার জন্য এনএসডি (ন্যাশানাল স্কুল অব ড্রামা) ছিল। কমার্স কলেজে পড়তে গেলেন কেন?
যখন আমার পনেরো বছর বয়স ছিল, তখন হয়তো ভেবেছিলাম ডিগ্রি অর্জন করব ও সব নিয়ে। কিন্তু ১৭/১৮ বছর বয়সে, স্থির করি যে আমি নিজেই ঠিক করব আমার পড়াশুনোটা কী ভাবে করা উচিত। ছোটবেলা থেকেই আমার জানার বেশ আগ্রহ ছিল। পড়াশোনায় মন্দ ছিলাম না। ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতাম বৈজ্ঞানিক হব। জাদুর উপরও ঝোঁক ছিল। বাড়িতে আমার মা, ঠাকুমা সিনেমা আর থিয়েটার খুব পছন্দ করতেন। সেটার একটা প্রভাব ছিল নিশ্চয়ই। যখন ‘কিঁউকি...’ লিখতে শুরু করি তখন আমি বেশ স্বাধীন। ভাল টাকাও কামিয়ে ছিলাম দু’টো শো লিখে। কিন্তু কুড়ি বছর বয়সেই আমি টেলিভিশন থেকে অবসর নিয়ে নিই। |
|
‘শিপ অব থেসিয়াস’ ছবির একটি দৃশ্য |
জনপ্রিয় শো, টাকা ভাল। সেটা ছেড়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে নিজেকে ঠেলে দেওয়ার পিছনে উসকানিটা কী ছিল?
‘ম্যালকম এক্স’ বলে একটা ছবি দেখেছিলাম। ছবিতে দুই ধরনের ‘স্লেভ’য়ের কথা বলা আছে হাউজ স্লেভ আর ফিল্ড স্লেভ। হাউজ স্লেভরা বাড়িতে থাকত। তাদের জীবনটা অনেক বেশি সচ্ছল। কিন্তু ফিল্ড স্লেভরা থাকত বাইরে। হাউজ স্লেভদের বাড়িতে আগুন লাগলে যদি কেউ যদি বলত চল ছুটে পালাই, তারা আপত্তি করত। আগুন নেভানোর চেষ্টা করত। বলত এর থেকে ভাল বাড়ি আর হয় না। কিন্তু ফিল্ড স্লেভরা চাইত আরও হাওয়া দিক যাতে বাড়ি জ্বলেপুড়ে যায়। তারা চাইত বিদ্রোহ করতে। এই মেটাফর আমার ক্ষেত্রে কাজ করে। আমি নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকি যে আমি কী জায়গাতে রয়েছি? আমি হয়তো অন্যদের থেকে একটু বেশি প্রিভিলেজড ছিলাম। কিন্তু আমার নিজের একটা দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। আমি চাইনি যে সেটা হারিয়ে যাক।
‘শিপ অব থেসিয়াস’ তো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সম্মানিত হচ্ছে। কিন্তু সাধারণ দর্শক, যাঁদের কাছে তুলসী আর মিহিরই বিনোদনের শেষ কথা, তাঁরা কি হিন্দি ছবিটা বুঝতে পারবেন?
নিশ্চয়ই। আমার ছবিতে তিনটে গল্প আছে। এক চিত্রগ্রাহক, এক সন্ন্যাসী আর এক স্টক ব্রোকারের গল্প নিয়ে ছবি। একজন অন্ধ চিত্রগ্রাহকের কর্নিয়া রিপ্লেসমেন্টের পরে কী হয়? একজন সন্ন্যাসী যিনি সারা জীবন মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন, তাঁর মনে কী প্রশ্ন জাগে মৃত্যুর দোরগোড়ায়? যখন তাঁর লিভার সিরোসিস হয় আর তাঁকে সেই সব মানুষের উপর ভরসা করতে হয় যাঁদের বিরুদ্ধে তিনি সরব ছিলেন। আর একজন স্টক ব্রোকারের গল্প যাঁর কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়। তার পর তিনি জানতে পারেন কী ভাবে একটা কিডনি চুরির চক্রান্ত চলে সারা বিশ্বে। কিছু দর্শক শুধু এই গল্পগুলোর সঙ্গেই রিলেট করবেন। কেউ এর নির্যাস নিয়ে অন্য প্রশ্ন করবেন নিজেদের সত্তাকে নিয়ে। ছবিটির নাম এসেছে থেসিয়াসের সেই প্যারাডক্স থেকে যার কেন্দ্রে ছিল একটা বস্তু। প্রশ্ন এটাই: যখন বস্তুটির ভেতরের অংশগুলোকে বদলে ফেলা হয় তখন কি আর সেটাকে আগের সেই বস্তুই বলা সম্ভব?
এই থেসিয়াসের মেটাফর নিয়ে আলোচনা কি সাধারণ দর্শক বুঝবে?
আমার ছবিটি কিন্তু বেশ এন্টারটেনিং। জুলাই মাসের উনিশ তারিখ মুক্তি পাবে। রিসার্চ করে দেখেছি যে অনেকেই আমাদের ছবিটি দেখতে চান যাঁরা একেবারেই ফেস্টিভালের দর্শক নন। মেনস্ট্রিম ছবি, সিরিয়াল দেখেন তাঁরা। আমি বুঝি না কেন আমরা হালকা কিছুর সঙ্গেই সব সময় বিনোদনকে মেলাতে চেষ্টা করি। কেন ভাবি যে যা কিছু বুদ্ধিদীপ্ত সেটাই বোরিং হবে? আমার মনে হয় যা কিছু বুদ্ধিদীপ্ত নয় সেটাই বোরিং। কে দায়িত্ব নিয়ে ঠিক করছেন যে সাধারণ মানুষ এটা বুঝবে না? আমাদের দেশে কিছু অলস গেটকিপার রয়েছেন। পরিশ্রম করতে হলে সেটাতে আর হাত দিতে চান না। তার ফলে ফ্যাক্টরির মতো এক গতে বাঁধা জিনিস তৈরি হয়। কিন্তু আমাদের স্টাডি বলছে যে এখনকার দর্শক বেশ বোর হয়ে গিয়েছে এক জিনিস দেখতে দেখতে। তারা অন্য কিছু চাইছে দেখার জন্য। |
|
কিরণ রাওয়ের সঙ্গে আনন্দ গাঁধী |
আপনি আগে একবার বলেছিলেন যে বলিউডের অনেক আলতুফালতু ছবিও ‘ইন্ডি ছবি’ বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ‘ইন্ডি ছবি’র অর্থটা কি তা হলে ভুল ভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে এখানে?
হ্যাঁ, ঠিক তাই। বিদেশে ‘ইন্ডি ছবি’ মানেই হল যেগুলো স্টুডিয়ো থেকে বানানো হয় না। আমাদের দেশে কি সেই ব্যাখ্যাটা খাটে নাকি? আমরা এখনও একটা সন্ধিক্ষণের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। নিজের ঢাক নিজে না পিটিয়েই বলছি, এখনও আমাদের এখানে আর একটা ছবির নাম বলতে পারব না যেটাকে আমার ছবির সঙ্গে একই জনারে ‘ক্লাব’ করা সম্ভব। একটা ‘ডেমোক্রাটাইজেশন অব দ্য মিডিয়াম’ হয়েছে। যে কেউ বেশ কম রিসোর্স দিয়েই ভাল ছবি করতে পারে। ইন্টারনেটের দাপটে গ্লোবাল সিনেমা সবাই দেখছে। সেই এক্সপোজারটা দর্শককেও তৈরি করেছে। তবে মিডিয়াকে আরও বেশি পড়াশুনো করতে হবে। এখনও অনেক ক্ষেত্রেই মিডিয়া ‘আন্ডারইনফর্মড’। বিনোদন সাংবাদিকতাকে মাঝে মাঝে মনে হয় যেন ক্যুরিয়ার সার্ভিস। রিফ্লেকশন, ডিকন্সট্রাকশন কই? শুধু প্রেস রিলিজ বহন করার মাধ্যম তো সাংবাদিকতা নয়। তবে সিনেমা ভাল তৈরি হলে ক্রিটিকদেরও অভিযোজন ঘটবে।
কিরণ রাও আপনার ছবি দেখে অভিভূত। ছবিটির মার্কেটিং আর ডিস্ট্রিবিউশনে কিরণের অবদান কতটা?
সব সিদ্ধান্তই কিরণের সঙ্গে আলোচনা করেই নেওয়া হয়েছে। কিরণ ছবিটি আমির খানকে দেখান। তার পর ইউটিভি-র রনি স্ক্রুওয়ালা আর সিদ্ধার্থ রায় কপূরকেও। ছবিটির যে পোস্টারটা আপনারা দেখছেন সেটাই ছিল অরিজিনাল পোস্টার। তার পরও আমরা দু’একটা পোস্টার বানিয়েছিলাম। কিন্তু আমির বলেন যে ছবিটির ভাবনাটা মাথায় রাখলে অরিজিনাল পোস্টারটি ব্যবহার করা উচিত। এটাও বলেছিলেন যে ছবিটির জন্য একটা ‘ভোট ফর ইয়োর সিটি’ ক্যাম্পেন করার কথা। ভোট দিয়ে বলতে হবে যে সেই শহরে ছবির মুক্তি দর্শক চান কিনা।
কিন্তু সব পরিচালক তো আর আমির, কিরণের সাহায্য পান না। অল্টারনেটিভ ছবির ডিসট্রিবিউশন কতটা কঠিন আমাদের দেশে?
প্রবাদ আছে, পিপল গেট দ্য লিডারস দ্যট দে ডিজার্ভ। আমি বলব দর্শক যে ধরনের ছবি চাইবে সেটাই তারা দেখতে পাবে। সত্যি যদি দর্শক চায় অন্য ধরনের ছবি দেখতে, তাদের নিজেদের গিয়ে থিয়েটার ম্যানেজারকে বলতে হবে সে কথা। আমার ছবিটা বেশ সিনেম্যাটিক। সেটা হল-য়ে গিয়ে দেখা উচিত। তবে দু’তিন বছরের মধ্যে নতুন ডিসট্রিবিউশন চ্যানেল আসবে। সরাসরি ছবি ইন্টারনেট রিলিজও হবে। |
|
শেষ পর্যন্ত এক অসাধারণ ফিল্ম মেকারের আবির্ভাব ঘটল... আমি নিশ্চিন্তে এ বার অবসর নিতে পারি
শেখর কপূর |
আনন্দ গাঁধীর ‘শিপ অব থেসিয়াস’ সম্ভবত ভারতে তৈরি হওয়া সব থেকে বুদ্ধিদীপ্ত ছবি। আমাদের সবাইকে লজ্জায় ফেলে দিল
অনুরাগ কশ্যপ |
‘শিপ অব থেসিয়াস’ তর্কহীনভাবে এক সিনেম্যাটিক মাস্টারপিস... আবেগ দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে তৈরি করা... এক অবশ্য দ্রষ্টব্য ছবি
কর্ণ জোহর |
|
শেষ কোন ভারতীয় ছবি দেখেছেন?
‘গুলাব গ্যাং’ দেখেছিলাম। খুব ভাল। আনন্দ পটবর্ধনের একটা ছবিও বেশ ভাল লেগেছিল। ‘ধোবি ঘাট’ দেখেছিলাম। আমার মেন স্ট্রিম ছবি দেখার সময় বা ধৈর্য কোনওটাই নেই।
আমিরের ‘থ্রি ইডিয়টস’ দেখেননি?
না, দেখিনি। এটা তো একটা স্বীকৃত জোক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলা ছবির খবর রাখেন?
হ্যাঁ। শেষ দেখেছি কিউ-এর ‘গান্ডু’।
শেখর কপূর, অনুরাগ কশ্যপ, কর্ণ জোহর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। প্রখ্যাত সমালোচক ডেরেক ম্যালকম এটাকে ‘ফিল্মস দ্যাট চেঞ্জ আওয়ার লাইফস’য়ের লিস্টে রেখেছেন। এর ফলে কি কাঁধে একটা বাড়তি ওজন অনুভব করছেন? একটা কুলি থাকলে কি ভাল হত?
(হা হা) না, তা নয়। এঁদের প্রশংসায় আমি উষ্ণ আবেদন অনুভব করি। এগুলো হল ক্ষণস্থায়ী আনন্দের মুহূর্ত। আমার দায়িত্ব হল নিজের ধারা না পালটে কাজ করে যাওয়া। আমি কোনও দিন কিছুর দ্বিতীয় সংস্করণ করিনি। পরের ছবিটা করছি একটা সহজ গল্প নিয়ে। কিন্তু তাতে এমন পরীক্ষা করব যেটা সারা বিশ্বের সিনেমাতেও নতুন। |
|