চলো জওয়ানো লড়কে দিখায়েঙ্গে—কপিল দেব ১৯৮৩ লর্ডস ইনিংস বিরতি। কেউ প্যাভিলিয়নের ডান দিকে ভুলেও তাকাবে না। যেখান থেকে বৃষ্টির মেঘগুলো আসে। ঈশ্বর বৃষ্টি পাঠিয়ে তোমাদের রক্ষা করবেন না। তোমরা বিশ্বকাপ জয়ী, নিজেরা নিজেদের রক্ষা করো। মহেন্দ্র সিংহ ধোনি ২০১৩ এজবাস্টন ইনিংস বিরতি।
মাত্র ১৮৩ রান করে হীনমন্যতায় ভুগতে শুরু করা টিমকে তার অধিনায়কের উদ্দীপ্ত করার ধরন আজও ভারতীয় ক্রিকেটমহলে প্রবাদসদৃশ হয়ে রয়েছে। রোববার রাতের পর থেকে এজবাস্টনে মাত্র ১২৯ রানে থেমে যাওয়া টিমকে চাগানোর ধরনও ইতিহাসে উঠে থাকল।
তিরিশ বছর আগে সে দিন অবশ্য কপিলদের হোটেলের বাইরে এই রকম বাঁধনহারা উচ্ছ্বাস হয়নি। লর্ডসের ঠিক পাশেই ছিল তাঁদের হোটেল। তখন তার নাম ছিল ওয়েস্ট মরলেন্ড। এখন নাম ড্যানিউবস। সোমবার সন্ধেবেলা সেই ড্যানিউবের লাউঞ্জে বসে ভাবার চেষ্টা করছিলাম এই থ্রি স্টার হোটেলের বাইরে ছোট কার পার্কে কত আর ভিড় হতে পারত! আজ সকালেও বার্মিংহ্যাম হায়াতের বাইরে ভারতীয়দের যা ভিড় দেখে এলাম, তার পাশে কোনও তুলনাই হবে না। কাল হোটেল কর্তৃপক্ষ তো রীতিমতো ঘাবড়েই গেছিলেন। এর পর যখন বিরাট কোহলি ভারতীয় টিমবাস থেকে নেমে তাঁদের সঙ্গে ভাঙড়া নাচতে শুরু করে দিলেন, তখন তাঁরা সাময়িক স্বস্তি পেলেন। চিৎকারে, ঢোলের আওয়াজে, ঢাক বাজানোর উচ্ছ্বাসে তখন হায়াত লবিটা ম্যাডক্স স্কোয়্যারের পুজো প্যান্ডেলের চেহারা নিয়েছে। |
সোমবার নীরবতায় ভরা লর্ডসে ঢুকতে গিয়ে মনে হল তিরিশ বছরে পরিস্থিতি কত বদলে গিয়েছে। এখন লর্ডস স্টিউয়ার্ডরা অনেক ভদ্র। প্রেস কার্ড দেখিয়ে যখন তখন ঢোকা যায়। ওপরে স্পনসরের নাম বড় করে লেখা থাকে। তিরাশির ২৫ জুন লর্ডস অনেক বনেদি ছিল। আমেরিকায় থাকা কপিল নস্ট্যালজিক হয়ে বলছিলেন, “তিরিশটা বছর যেন হু হু কেটে গেল। এই তাকালে দেখতে পাই সাঁধু বোল্ড করছে গ্রিনিজকে। ব্যাস ম্যাচ ঘুরে গিয়েছে।”
ধোনি তো শেষ বল অবধি আন্দাজ পাননি খেলার যে মোড় ঘুরেছে। তাই বিশ্বকাপ ফাইনালে উইনিং ছয় মেরে শান্ত থেকেও এজবাস্টনের শেষ বলের পর জীবনে প্রথম প্রকাশ্য এত আবেগ দেখালেন। আনন্দবাজারকে পরে বললেন, “আবেগ দেখাব না কী বলছেন! এই রকম একটা হেরে যাওয়া ম্যাচ। তা-ও ইংল্যান্ডের মাঠে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে।”
মদন লাল বলছিলেন, “ডাবল আনন্দ হচ্ছে আজ যে আমাদের ২৫ জুন আর ওদের ২৩ জুন একসাথে মিলে গেল। দেশের কত বড় গর্ব।” তিরাশির ২৫ জুনের পঁচিশ বছর পূর্তিতে এখানে জড়ো হয়েছিল সে বারের বিশ্বজয়ী টিম। “এ বার কপিল আমেরিকায় বলে আর কিছু হল না,” বললেন সুনীল গাওস্কর। বেঙ্গসরকরকে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের একটা সংগঠন সোমবার রাতে লর্ডস অ্যাকাডেমিতে প্রীতি ম্যাচে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল তিরিশ বছর পূর্তিতে। বেঙ্গসরকর যাচ্ছেন না। সে দিনের ম্যান অব দ্য ম্যাচ তিনিও তো মুম্বইয়ে। শুধু ফোনে বলছেন, “সবাই বলে ভিভের ক্যাচ। আমি ওটা নেওয়ার পরেও ভেবেছিলাম, কে আউট হল দেখার দরকার নেই। আর একটা উইকেট চাই।” এখনকার নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান সন্দীপ পাটিল ফাইনালে তাৎপর্যপূর্ণ কিছু না করতে পারলেও সেমি-তে বব উইলিসকে এক ওভারে পাঁচটা বাউন্ডারি মেরেছিলেন। মুম্বই থেকে এসএমএসে পাটিল বললেন, “এখন লজ্জাই লাগে এখনকার ছেলেরা কী মারকুটে ক্রিকেটই না খেলে। তার পাশে কোথায় আমি।” ধোনিদের সাফল্য দেখার পর তাঁর মুগ্ধ প্রতিক্রিয়া, “তিরাশি নিয়ে অনেক হয়েছে। এ বার ধোনিদের নিয়ে মানুষ ভাবুক। কেবল ওদের গৌরবগাথা নিয়ে।”
সোমবারের লন্ডনে উইম্বলডন শুরুর দিনেই কত বিস্ফোরণ। অজি সংক্রান্তও চাঞ্চল্যকর খবর। নাদালের মতো মহাতারকার বিদায়। সেরেনা বনাম শারাপোভা মাঠের বাইরের লড়াই নিয়ে কৌতূহল যে শারাপোভা আজ জবাবে প্রেসকে কী বলবেন! অ্যান্ডি মারে সম্পর্কে টেনিস গুরু নিক বলতিয়েরির কী উইম্বলডন পূর্বাভাস? ও দিকে অ্যাসেজ শুরুর মাত্র দু’সপ্তাহ আগে নজিরবিহীন ভাবে বরখাস্ত অজি কোচ মিকি আর্থার। তবু বড় খবরের এত ভিড়েও ইংরেজরা এজবাস্টনে তাদের ক্রিকেটস্বপ্নের প্রতিমা নিরঞ্জন মেনে নিতে পারছে না। |
তিরিশ বছর আগের প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড ছিল না। কিন্তু ম্যাচের ফলে প্রতিক্রিয়া ছিল একই রকম বিস্ময়সূচক। বিশ্বকাপ জয়ী দলের একাধিক সদস্য বলেছেন, সবচেয়ে অবাক লাগে যখন লোকে অবিকল মনে করতে পারে তিরিশ বছর আগের ওই দিনটায় ওই সময় ওরা কোথায় কী ভাবে খেলা দেখেছিল। নাদিয়া কোমানিচি যেমন বলেন, জিমন্যাস্টিক্সে পারফেক্ট টেন তো আরও হয়েছে, কিন্তু মন্ট্রিয়ল অলিম্পিকের ওই দিনটা যেহেতু প্রথম, সবাই মনে করতে পারে, ওই দিনটাতে ওরা তখন কোথায় কী করছিল। কপিল দেব বলেন, “২৫ জুন এমন একটা দিন যে বিয়ের তারিখও চাইলে ভুলতে পারবেন, এইটা কেউ না কেউ কোনও না কোনও ভাবে মনে করিয়ে দেবেই।” মদনলালের মতে, এজবাস্টনে কাল ধোনির কৃতিত্ব তাঁদের চেয়ে অনেক বেশি। “আমাদের ওপর কোনও চাপই ছিল না। খুশি মনে, খোলা মনে খেলতে পেরেছি। ওরা স্পট ফিক্সিংয়ের সময় থেকে কী পরিমান চাপকেও মাঠে খেলে জিতল।” কিন্তু মদনও মনে করেন, শুরুটা তিরাশি থেকেই। “পরবর্তীকালে যে আমাদের যত বড় ক্রিকেটার হোক, সচিন কী সহবাগ কী দ্রাবিড়, সবাই বিশ্বকাপ জিততে চেয়েছে।”
ধোনি পরশু দিন বলছিলেন, “তিরাশির সে দিন আমার বয়স ছিল মাত্র দুই। কিছুই বুঝিনি। জানতামও না। পরে জেনেছি। সেই টিম আর সাপোর্ট স্টাফকে আজ আমি আবার বাহবা দিতে চাই।” ভারত অধিনায়ক জানেন না তিরিশ বছর আগের পৃথিবীতে কোনও কোচই ছিল না কপিলদের। তো সাপোর্ট স্টাফ কী।
লর্ডসও তো বদলে গিয়েছে। তার জাদুঘরের ভেতরেও আপাদমস্তক উদগ্র বাণিজ্যিকরণ। দোতলাটায় ভিভের নতুন তৈলচিত্র বসলে, মাঝের ক্যাবিনেটে অ্যাসেজ রাখা থাকলেও ক্রিকেট রোম্যান্টিকের দীর্ঘশ্বাস পড়ানোর পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু এক তলায় ঢুকতেই সাদা ট্রফিটা ঝকঝক করছে প্রুডেনশিয়াল কাপ। যা তিরাশির পর আর দেওয়া হয়নি। কপিলরাই শেষ। বার্মিংহ্যামে ধোনিরা আরও দু’দিন থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ উড়বেন। হোটেল থেকে বেরোবার আগে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেলাম, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিটা কোথায়?
২৩ জুনের এটা আর ২৫ জুনের তিরিশ বছর পূরণটা—অদ্ভুত এক বন্ধনীতে ভারতীয় ক্রিকেটকে জুড়ে দিল এই দেশে। নবীন এসে সস্নেহ হাত ধরল প্রবীণের।
খেলোয়াড় যায়-আসে। কীর্তি বেঁচে থাকে। অব্যাহত রেখে দেয় দেশজ গৌরবের পরম্পরা। আজ যার নাম—লর্ডস থেকে এজবাস্টন। |