|
|
|
|
ছকভাঙা পথে হেঁটেই চ্যাম্পিয়ন এমএসডি
গৌতম ভট্টাচার্য • বার্মিংহ্যাম |
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে পেলাম ওঁদের সোমবার দুপুরে। প্রথম জন গ্রেগ চ্যাপেল, মেলবোর্নে। মদন লাল দিল্লিতে। আর দিলীপ বেঙ্গসরকর সবে লন্ডনের হোটেলে চেক ইন করেছেন।
তিন বিভিন্ন টাইম জোনে থাকা তিনের বক্তব্যের ঘড়ির কাঁটা কিন্তু একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। সেই কাঁটার নাম মহেন্দ্র সিংহ ধোনি!
জীবিত, মৃত, আমার সময়ে, তার আগে, নিজে কোচিং করাবার সময় যত ভারত অধিনায়ক দেখেছি। ধোনিই সর্বোত্তম— গ্রেগ চ্যাপেল।
কোনও সন্দেহ নেই আমার দেখা সর্বকালের সেরা ইন্ডিয়ান ক্যাপ্টেন। ইস, যদি ধোনির অধীনে খেলতে পারতাম— মদন লাল।
যখন ওকে ক্যাপ্টেন বাছি, ভাবতেও পারিনি এই পর্যায়ে পৌঁছবে। অবশ্য সেটা ছোটবেলায় সচিনকে দেখেও বুঝিনি যে, এক দিন ও সবাইকে ছাপিয়ে যাবে —দিলীপ বেঙ্গসরকর।
ওপরের তিন জনের মধ্যে মদন লাল সে ভাবে ধোনিকে চেনেন না। পরিচয় আছে কি না, তা-ও অনিশ্চিত। কিন্তু অধিনায়ক ধোনির জন্মকুণ্ডলীতে বাকি দু’জনের অপরিসীম ভূমিকা! গ্রেগ প্রথম স্পট করেন টিমে একেবারে জুনিয়র ধোনির নেতৃত্বদানের ক্ষমতা। প্রথম তাঁর সুপারিশে ধোনিকে প্রায় মাটি ফুঁড়ে, আচমকা ভাইস ক্যাপ্টেন করে দেওয়া হয়। বাকিটা ইতিহাস।
রোববার রাতের এজবাস্টনে অ্যালিস্টার কুকের সাংবাদিক সম্মেলনে একটা আশ্চর্য জিনিস লক্ষ্য করা গেল। হেরে গেলে নিজের দেশে সাংবাদিক সম্মেলন, হয় প্রচণ্ড উত্তপ্ত। না হলে চট করে শেষ হয়ে যায়। এখানে এমন নীরবতা, যেন এক দল লোক চার্চে সমবেত প্রার্থনা করতে বসেছে! কুক মাথা নিচু করে এমন ক্লিষ্ট মুখচোখে বসে যে, একটু পরে যখন বললেন, ইংল্যান্ড অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে যন্ত্রণা আর লজ্জার দিন আজ, তাঁকে না জিজ্ঞেস করেও সে কথা তাঁর মুখে বসিয়ে দেওয়া যেত! বিশ্বপর্যায়ের ওয়ান ডে ফাইনালের সর্বকালের সহজতম পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে পারেনি তাঁর দল। শেষ ১৮ বলে ২০ করতে হবে। হাতে ছ’উইকেট। ইংল্যান্ড ‘এ’ টিমও এমন অবস্থায় হারিয়ে দিত! আর সেই পরিস্থিতিতেই কিনা আত্মসমর্পণ করে ব্যাটসম্যানরা ইংল্যান্ডের প্রথম বিশ্বপর্যায়ের টুর্নামেন্ট জেতার প্রতীক্ষাকে চল্লিশ বছর আর সতেরোটা টুর্নামেন্টে নিয়ে ফেলল! |
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি হাতে জয়ের তিন স্থপতি ধবন, ধোনি, জাডেজা।
বার্মিংহ্যামের সিটি কাউন্সিলে। সোমবার। ছবি: রয়টার্স |
ধোনি যখন আঠারোতম ওভারে ইশান্ত শর্মাকে আনলেন, ভারতীয় প্রেস মুণ্ডপাত করছিল তাঁর! ইশান্ত তার আগে ৩ ওভারে ২৭ দিয়েছেন। একাই তো তিনি হারিয়ে দেবেন! কেন অশ্বিনকে ওভারটা দেওয়া হল না? প্রথম দুটো বল ওয়াইড করে ইশান্ত গালাগালের তীব্রতা বাড়াচ্ছিলেন। এর পরই মর্গ্যানের আত্মঘাতী শট। পরের বলে বোপারা এবং টিম ইন্ডিয়ার মহানাটকীয় প্রত্যাবর্তন।
ফেসবুকে দ্রুত পোস্ট দেখা গেল, মহেন্দ্রবাবুর চওড়া কপাল। বেঙ্গসরকর নিজেও বলছিলেন, “ভাগ্য আছে ছেলেটার, না হলে এই পর্যায়ে ক্যাপ্টেন হিসেবে যেত না!”
জোহানেসবার্গে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালে আবার ওভার গুনতে ভুল করে যোগিন্দর শর্মাকে শেষ ওভার দিয়েছিলেন ধোনি। কপিলকে যেমন আজও শুনতে হয়, শারজার শেষ ওভারটা কেন চেতন শর্মার জন্য রাখতে গেছিলে, ধোনিকেও শুনতে হতে পারত। অথচ ধোনির বেলায় মিসবা-উল-হকের মতো ব্যাটসম্যান আউট হয়ে যান! কপিলের বেলায় মিয়াঁদাদ ছয় মেরে দেন! পরবর্তী কালে অবশ্য যোগিন্দর শর্মাকে পাড়া স্তরেও কোনও ক্রিকেটে কিছু করতে দেখা যায়নি। ক্রিকেটীয় আশীর্বাদের মতো তিনি ওই একবারই এমএসডি-র ওপর ঝরে পড়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করে দিয়েছিলেন। ওই শেষ। শোনা যায় যুবরাজ-গম্ভীররা বন্ধুমহলে একাধিক বার বলেছেন, সবাই আমরা কাছাকাছি ভাল। এমএসের ভাগ্যটা ওকে আলাদা জায়গায় নিয়ে গিয়েছে। রোববার রাত্তিরে ধারাভাষ্যকারদের বক্স থেকে বেরনোর সময় অনেকের মুখে শুনলামভাগ্যের বরপুত্র। না হলে ফাইনালে এই হারা ম্যাচ বেরোয় না।
ক্রিকেট-সার্কিটেই আবার আর এক শ্রেণিভুক্ত আছেন যাঁদের বক্তব্য, ভাগ্য যোগ্যদেরই সহায় হয়। গ্রেগ চ্যাপেল মনে করেন সেই আদিম আপ্তবাক্যের প্রতীক হলেন ধোনি। গাওস্কর আর গ্রেগ৯৯.৯ শতাংশ ইস্যুতে দ্বিমত পোষণকারী। অথচ গাওস্করও এ দিন মুগ্ধ বিস্ময়ে বলেছেন, ধোনি ভস্ম থেকে জন্মাতে জানে। আর রবি শাস্ত্রী মনে করেন, ধোনির ক্যাপ্টেন্সি ইনস্টিংক্ট, যাকে অনেকে বিদ্রূপ করে বলেন যে আসলে বাজিগুলো খেটে যায়, সেটা আসলে নেতৃত্বের সহজাত দক্ষতা। সোমবার সকালেও বার্মিংহ্যামে ভারতীয় টিম হোটেলের বাইরে একরাশ ভিড়। সবাই চায় ধোনিকে দেখতে। এক ব্রিটিশ কোম্পানির বিপণন কর্তা এসেছেন। তিনি কাল মাঠে ইশান্তকে ওই সময়ে বল দেওয়ায় ধোনিকে নিয়ে হেসেছিলেন। আজ দেখা করে বলতে এসেছেন, কী ভাবে আপনার মন কাজ করে এটা যে কোনও ম্যানেজমেন্ট সংস্থা জানতে চাইবে। তাঁকে বলা হল না যে, বিশ্বকাপ জেতার পর একটি বিশ্ববিদ্যালয় ধোনির ব্রেন ম্যাপিংয়ের দাবি তুলেছিল। |
এই বিষয়ে আরও ছবি বা ভিডিও দেখতে পাশের QR কোডটি স্ক্যান করুন। |
মাইকেল আর্থারটন গত দু’বছর ধোনির তীব্র সমালোচক। এ বারও ভারত সফরে আসা ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ধোনি যে মনোভাব দেখিয়ে সিরিজ হেরেছেন, তা স্পষ্টই গা ছাড়া বলে মনে হয়েছিল আর্থারটনের। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে এত চাপের মুখে ধোনির দল পরিচালনার ক্ষমতা দেখে তিনি কিন্তু মুগ্ধ। আর্থারটন লিখছেন, ‘চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিটা চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটারের হাতেই শোভা পাচ্ছে।’ চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটার শব্দটা সব ধরনের ক্রিকেট মিলিয়ে খুব একটা শোনেন না ধোনি। টেস্ট ক্রিকেটে দুধর্র্র্ষ ডাবল সেঞ্চুরির পরেও তাঁর পরিচিতি মুখ্যত ওয়ান ডে এবং টি-টোয়েন্টি জগতের মুকুটহীন নায়ক হিসেবে।
রোববারের অবিশ্বাস্য জয় তাঁকে কুলীন ক্রিকেটার করে দিল। কপিল, গাওস্কর, কুম্বলে, সহবাগ, দ্রাবিড়, সচিন, সৌরভের পাশে একই শ্রেণিতে তিনি বসে গেলেন।
লর্ডসে সোমবার বিকেলে দেখা হয়ে গেল রাজীব শুক্লর সঙ্গে। আপাতত তীব্র শ্রীনি-বিরোধী রাজীবের মুখেও এক কথা, “মাহির ক্যাপ্টেন্সিটা সত্যি তাগড়া।” ইংল্যান্ড ক্রিকেটমহল এর আগে ধোনির ক্যাপ্টেন্সি নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়নি। কারণ এ দেশে তাঁর হাতেগরম সাফল্য কখনও ছিল না। গ্রহণযোগ্যতার একটা সমস্যা ছিল— ইংল্যান্ড যাকে ঐতিহাসিক ভাবে ক্যাপ্টেন্সি মনে করে সেটা যদি ক্রিকেটে মানব-সভ্যতা হয়, ধোনি হলেন ব্যতিক্রমী এস্কিমো। বরফের ঘরে আপন নিয়মে থাকেন। যে দেশে মাইক ব্রিয়ারলির ‘আর্ট অব ক্যাপ্টেন্সি’ বই এবং পুঁথিগত চিন্তার প্রবেশ ঘোরতর নিষিদ্ধ।
ধোনি ঘোষিত ভাবেই ইংলিশ কপিবুক বিরোধী। সৌরভ আর তাঁর অনেক জায়গায় মিল। কিন্তু ঘোরতর অমিল হল এই চেতনায় যে, সৌরভ তারকার শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী। ব্যক্তিগত প্রতিভায় বিশ্বাসী। ধোনি নন। |
|
ধোনিজম-এর স্তম্ভগুলো হল:
১) ট্যালেন্ট নয় বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল অ্যাটিটিউড। স্টাইলের রোম্যান্স চাই না। চাপে পড়ে বার হওয়ার রাস্তা যদি জানো, সেটাই ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় রোম্যান্স।
২) নাম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ফিটনেস গুরুত্বপূর্ণ। ফিট হওয়ার জন্য রোজ জিম যেতে হবে না। কিন্তু তা বলে ফিট নয় অথচ টিমকে ফাঁকি দিতে নেমে পোড়ো না। তা হলে আমি হিসেব বুঝে নেব। উদাহরণ সহবাগ। উদাহরণ যুবি।
৩) ওয়ান ডে টিমে থাকতে হলে ফিল্ডিং ভাল হতেই হবে। নইলে মহাতারকা হয়েও রক্ষা পাবে না। নমুনা তেন্ডুলকর। নমুনা সৌরভ।
৪) কোচিং ম্যানুয়্যাল পড়তে হবে না। টিম মিটিং, থিওরি ও সব চাই না। মাঠে কাজ চাই। সাহস চাই। বক্তৃতা চাই না।
৫) মিডিয়া কী লিখল মাথা ঘামিও না। মিডিয়া একটা অপ্রয়োজনীয় উৎপাত— আছে, আছে। দূরে থাক।
৬) নিজে যেটা মনে করবে সেটাই ঠিক মনে করে এগোবে। মিডিয়া বা এক্স প্লেয়ার কী বলল, মাথায় রাখার দরকার নেই। প্রাক্তন প্লেয়ারও মিডিয়ার মতোই একটা প্রজাতি যাকে কখনও মাথায় তুলতে নেই।
৭) দেশের হয়ে টানা খেলার জন্য অমানুষিক শারীরিক কষ্ট সহ্য করার জন্য তৈরি থাকো।
৮) টিমের ওপর কোনও রকম নাক গলানো হবে না। সবাই তার মতো স্পেস পাবে। দুটো জিনিস চলবে না— মাঠে ভয় পেলে চলবে না। আর ফিল্ড সাজানোর সময় আমার থেকে চোখ সরানো যাবে না যে ওকে আমি কোথায় দাঁড়াতে বলছি।
ধোনির স্টাইলটা এতই প্র্যাক্টিক্যাল এবং প্রচলিত ক্রিকেট-ধরন বিরোধী যে, ইংল্যান্ড অনেক বছর মানতে চায়নি ক্রিকেট-চর্চাকারী। অনেকে এটাও বলার চেষ্টা করেছেন, এই ম্যানুয়্যাল কী করে ক্যাপ্টেন্সির বাইবেল হতে পারে! রোববার রাত থেকে তাঁরাও চুপ— তুঙ্গ সাফল্যের বিরুদ্ধে কথা চলে না। আর এই মুহূর্তে সাফল্যের ছোট আদ্যক্ষরই হল— এমএসডি!
|
পুরনো খবর: তিরাশির দেশে এ বার ময়ূর সিংহাসন ছিনিয়ে নিলেন ধোনিরা
|
|
|
|
|
|