ভারতীয় সমাজের মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অচলায়তন বুঝি কিছুতেই ভাঙিবার নয়। সামাজিক আন্দোলন, আইন সংশোধন, প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ— কোনও কিছুই প্রথাগত ধারণার পরিবর্তনে সক্ষম হয় না। ট্রান্সজেন্ডারদের (যাঁহাদের শারীরিক লিঙ্গ-পরিচয় তাঁহাদের যৌন-সত্তার সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়) ক্ষেত্রে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতেও সেই অপরিবর্তন অব্যাহত। নির্বাচন কমিশন তাঁহাদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসাবে গণ্য ও নথিভুক্ত হওয়ার অধিকার দিয়াছে, সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র হইতে শুরু করিয়া ‘আধার’ কার্ডেও যাহার অন্তর্ভুক্তি আবশ্যক। গত বছরেই শীর্ষ আদালত এই মর্মে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলিকে স্পষ্ট নির্দেশও পাঠায়। কিন্তু ভারতীয় সমাজ যে এখনও এই আত্তীকরণের চেতনায় দীক্ষিত হয় নাই, তাহা স্পষ্ট। সম্প্রতি খাস সুপ্রিম কোর্টেই তিন জন ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি একটি আবেদন জানাইতে গেলে দরখাস্ত পূরণ হইতে নিরাপত্তার কারণে দেহ-তল্লাশি অবধি প্রতিটি পদে তাঁহাদের লিঙ্গ-পরিচিতি লইয়া যে চরম বিভ্রান্তির সৃষ্টি হইয়াছে, তাহা এই বাস্তবেরই প্রমাণ। ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসাবে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য এই ‘প্রান্তিক’ জনগোষ্ঠীকে যে আন্দোলন করিতে হইয়াছে, তাহা ভারতীয় সমাজের চিন্তার সীমিত ও সংকীর্ণ রূপটিকেই দেখাইয়া দেয়। প্রাচীন ভারতের সমাজ কিন্তু এত অনড়, স্থবির, শিলীভূত ছিল না। তাহার গতিময়তার প্রধান উপাদানই ছিল তাহার উদার আত্তীকরণের ঝোঁক। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য পাঠ করিলে, চিত্রকলা ও মন্দির-ভাস্কর্য দেখিলে, প্রাজ্ঞ বাৎস্যায়নের সূত্রাবলি অধ্যয়ন করিলেও দেখা যাইবে, বহুর সাধনা, বিভিন্নতার জয়গান, বৈচিত্র্যের স্বীকৃতি এই সমাজে ওতপ্রোত ছিল। সেই উদার বহুত্বের উপর প্রথম আঘাতটি যদি আসে তথাকথিত মধ্যযুগে, তবে সর্বাপেক্ষা মোক্ষম আঘাতটি আসে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীদের শাসনের সময়। ভিক্টোরীয় মূল্যবোধ প্রথমে ভারতীয় এলিট বা অভিজাতদের, পরে ক্রমশ বৃহত্তর সমাজেও পরিব্যাপ্ত হয়।
অতঃপর এমন একটা সামাজিক রক্ষণশীলতাকে ভারতীয় সমাজের চরিত্রলক্ষণ রূপে দাগিয়া দেওয়া হয়, যাহা আরোপিত, আমদানিকৃত। পোশাক হইতে শুরু করিয়া খাদ্যাভ্যাস, উৎসব, সামাজিক আচরণ, সর্বোপরি যৌনতা সম্পর্কিত ধ্যানধারণা ও অনুশীলন অবধি পাশ্চাত্য প্রভাবে সংকীর্ণ, বিকৃত হইতে থাকে। সমকামিতার ‘অপরাধ’-এ দণ্ডবিধান ভারতীয় বিচারব্যবস্থার অঙ্গ ছিল না, ব্রিটিশ আইনেই তাহা এ দেশে চাপাইয়া দেওয়া হয়। এই বিকৃতিগুলি সংশোধন করার সময় আসিয়াছে। কিন্তু সে পথে প্রধান বাধা সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। ব্যক্তির সব ধরনের পছন্দের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যেমন গণতন্ত্রের সাধনা, তেমনই তাহার সর্বপ্রকার আত্মপরিচয় সমর্যাদায় বিজ্ঞাপিত করার স্বাধীনতা মঞ্জুর করাও তাহার কর্তব্য। একদা ভারতীয় বহুত্বের সাধনায় বৈচিত্র্যকে সাদরে আলিঙ্গন করার এই প্রবণতা অন্তর্নিহিত ছিল। সেই সুদিন ফিরাইয়া আনিতে সমাজ যত্নবান হইবে না কেন? |