|
|
|
|
বিগ্রহের ঠাঁই রেশন দোকানে |
এক রাতের তাণ্ডবে শিবপুরীর নিসর্গে শ্মশানের স্তব্ধতা
অগ্নি রায় • দেবপ্রয়াগ |
যে পথে এগিয়ে চলেছি, তার দু’পাশে সরে সরে যাচ্ছে বিপর্যয়ের ভয়ঙ্কর ছবি। ধ্বংসের শুরুটা কোথায় আর কোথায়ই বা শেষ, ‘স্বেচ্ছাচারী’ বানের সামনে দাঁড়িয়ে এই সব প্রশ্ন-উত্তর গুলিয়ে যাচ্ছে।
বৃষ্টির তীব্র ছাঁটে বারবার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে সামনের উইন্ডস্ক্রিন। ওয়াইপার চটজলদি মুছে দিলে, সামনেটা স্পষ্ট। কিন্তু সামনে যা দেখছি এবং পিছনে যা ফেলে আসছি, তাকে কি ঠিক বাস্তব বলা চলে?
হৃষীকেশ থেকে শিবপুরী হয়ে রুদ্রপ্রয়াগের দিকে চলেছি। এক কথায়, ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে যাত্রা। গোটা রাস্তা ঘনঘোর বৃষ্টি। পাল্লা দিয়ে ফুঁসছে গঙ্গা। “গত বিশ বছরে গঙ্গার এমন ভয়ানক রূপ দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না”, বললেন আইটিবিপি-র জওয়ান যশপাল যাদব। তাঁর বাড়ি ভেসে গিয়েছে নীলকণ্ঠে। কোনও মতে রক্ষা পেয়েছে পরিবার। কিন্তু সে সব ভুলে টানা দু’দিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে (মুখচোখই বলছে, বেশ কয়েক দিন দু’চোখের পাতা এক করতে পারেননি) তিনি তাঁর দলবল নিয়ে বাঁচিয়েছেন অন্তত শ’দেড়েক মানুষের প্রাণ। বিপর্যয় গভীর হলে বোধহয় এ ভাবেই ঝলমল করে মানবিকতার মুখ। |
|
মন্দির জলের তলায়। উত্তরকাশীর এক ঘাটে দাঁড়িয়েই পুজো সারছেন পুরোহিত। |
চার মাস আগেই এই শিবপুরীতে এসে দেখেছি, সোনালি বালির উপর রংবেরঙের ছাতা। র্যাফটিং-এর ঢালাও বন্দোবস্ত। বিদেশি পর্যটকদের রোদ পোয়ানোর শান্তিপূর্ণ জায়গা। মনে হয়েছিল, প্রকৃতি যেন উজাড় করে সব ঢেলে দিয়েছে এই শিবপুরীতে। সেই শান্ত গঙ্গার গর্জন যেমন বাড়ছে, আইটিপিবি-র অভিজ্ঞ জওয়ানরা জানাচ্ছেন, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একটু একটু করে আবার বাড়ছে জলও। তীরের যতটুকু কাছে যাওয়া যায়, সাবধানে নিয়ে গিয়ে দেখালেন তাঁরা। যে দিকে তাকাই হাড়গোড় আর গাছের শ্মশান। প্রায় রাস্তা পর্যন্ত উঠে এসেছে সে সব। “অনেক বড় বড় গাছ ওই দুই রাতে ভেঙে পড়েছে”, কথা শেষ করার আগেই হাত দিয়ে দেখালেন যশপাল। না, গাছ নয়। ওই প্রবল স্রোতে ভেসে আসছে অনেকগুলো কালো ধূসর বিশালাকার কিছু।
স্পষ্ট হল কাছে আসায়। মোষের মৃতদেহের মিছিল! যশপাল বললেন,“গতকাল পর্যন্ত মানুষের দেহ ভেসে আসতে দেখেছি।”
এই শিবপুরীতেই তাঁদের তাঁবু গত দশ বছর ধরে। এমন অভিজ্ঞতা এই প্রথম। ১৬ তারিখ রাতে প্রবল শব্দে সবাই বেরিয়ে এসে দেখেন জল যেন গিলতে আসছে। “প্রবল বৃষ্টি তো ছিলই। বিকেল থেকেই দেখছিলাম অসংখ্য গ্যাসের সিলিন্ডার, সিনটেক্সের ট্যাঙ্ক, গাড়ির স্টেপনি এমন বিচিত্র সব জিনিস ভেসে আসছে। রাত বাড়তে হঠাৎই মনে হল, কোনও জন্তু যেন আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে চিৎকার করছে। সেই অবস্থায় যত জনকে পেরেছি, নদীর তীর থেকে নিয়ে এসেছি আমরা। নিজেদের তাঁবুও কিছু বাঁচানো গিয়েছে। কিন্তু অনেক তাঁবু এবং মানুষ ভেসে গিয়েছে হরিদ্বারের দিকে। কিছু করা যায়নি।” স্পষ্টই খেদ জওয়ানদের গলায়। হাতে সময় ছিল না তাঁদের। |
|
এক পুণ্যার্থীকে উদ্ধার করে আনছেন জওয়ান। নীচে ফুঁসছে অলকানন্দা। |
জল উঠে এসেছিল প্রায় ৪০ ফুট। আরও উঠলে পিছনের পাহাড়ে পিঠ ঠেকে যেত সবার। আবার যদি মেঘ ভাঙে, তা হলে সেই পরিণামই হবে কি না, এখনও নিশ্চিত নন এই জনা ত্রিশেক জওয়ান। বলতে গেলে মৃত্যুর সঙ্গেই যেন ঘর বেঁধেছেন তাঁরা।
মৃত্যুর এই হিম-সংসারে তাঁদের বিদায় জানিয়ে আবার ভাঙা পথের দিকে। রাস্তা মেরামতের কাজ চলছে পুরোদমে, কিন্তু তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ক্ষত। বড় বড় পাথর পড়ে সঙ্কীর্ণ হয়ে গিয়েছে গিরিপথ। সম্পূর্ণ পর্যটক শূন্য পথে (যা নিয়ে এই বিপর্যয়ের মধ্যেও বিলাপ করতে শোনা গেল রিভার অ্যাডভেঞ্চার সংস্থার মালিকদের!) শুধু সামরিক বাহিনীর জিপ, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং ত্রাণবাহী ট্রাকের ঘনঘন যাতায়াত। যাওয়ার পথে কারও জন্য কারও সময় নেই। রুদ্রপ্রয়াগ হয়ে বদ্রীনাথের দিকে যাওয়া অন্তত দু’টি লরি চোখে পড়ল। বীভৎস ভাবে তুবড়ে উল্টে পড়ে আছে বোঝাই বিস্কুটের প্যাকেট পেটে নিয়ে। কেন এই হাল, চালকদেরই বা কী হল, তা বলার জন্যও ত্রিসীমানায় কেউ নেই।
তিনধারা পেরিয়ে দেবপ্রয়াগের কাছে পৌঁছনো গেল ফাটল ধরা রাস্তা বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে। একটি ছোট আশ্রম, আর তাকে ঘিরে মুষ্টিমেয় বসতি। জল এসে পা ছুঁয়ে গিয়েছে মন্দিরটির। গ্রাস করেনি। ওই মন্দিরের সর্বক্ষণের পূজারী (ইনি কিন্তু জটাজুটধারী বা ভস্মমাখা নন, শহরের সৌম্য দর্শন ব্রাহ্মণের মতোই চেহারা) ব্রীজমোহনানন্দ। |
|
কেদারনাথের কাছে হেলিকপ্টারে ওঠার ভিড়। |
তাঁর গলায় মিলেমিশে তীব্র ক্ষোভ এবং চাপা আবেগ। বলছেন, “এটা কেন হল তা কি কেউ একবার ভেবে দেখবে না? অনাচার তো কানায় কানায় পূর্ণ হয়েছে। আগে এই দেবধাম ছিল সংসারে ক্লান্ত মানুষদের তীর্থের জায়গা। এখন চারধাম যাত্রার নামে সব গাড়ি হাঁকিয়ে পিকনিক আর মধুচন্দ্রিমা করতে আসছে। এখানে যা আনা নিষিদ্ধ, সেই মুরগি আর পিপে পিপে মদ আনছে। মহিলা নিয়ে ফূর্তি করছে। এটা ঈশ্বরের চেতাবনি! এখনও সময় রয়েছে। মানুষ যদি তার ভাবনা না বদলায় তা হলে মা গঙ্গা সব ধ্বংস করে দেবে। কিচ্ছু বাঁচবে না।”
আবার যদি প্রলয় শুরু হয় তা হলে কী বাঁচবে বলা খুবই শক্ত।
কয়েক বছর আগে এই মেঘ ভাঙার বিপর্যয়ের পর লে-তে গিয়েও দেখেছিলাম এক মৃত্যুপুরী। কিন্তু সেখানে জনবসতির উপর এ ভাবে পাহাড় ঝুঁকে পড়েনি। এমন ভয়াবহ খাদ ছিল না। এখানে যতই উপরে উঠেছি, দেখেছি খাদের ধার বরাবর রাস্তায় যে ধাতব রেলিং থাকে, তাকে বিভিন্ন জায়গায় দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে এক প্রবল শক্তি।
এই বিপর্যয় যেন আরও বেশি মারাত্মক। পুনর্বাসন তাই যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ। দেবপ্রয়াগে অলকানন্দা এবং ভাগীরথীর সঙ্গমস্থলে গা ঘেঁষে সব মন্দিরই প্রায় জলে ভাসছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, আপৎকালীন পরিস্থিতিতে বিগ্রহকে নাকি উপরের রেশন দোকানেও ঠাঁই নিতে হয়েছে! এখন অবশ্য জল তুলনায় কিছুটা নেমেছে। কিন্তু খাঁ খাঁ করছে মন্দিরগুলো। বিগ্রহ ফেরানোর ঝুঁকি নিতে সাহস পাচ্ছেন না সাধুরা। কারণ জল এখনও ফুঁসছে, বৃষ্টি এখনও লাগাতার। |
সোমবার পিটিআই ও এএফপি-র ছবি। |
পুরনো খবর: প্রকৃতির চোখরাঙানিতে আতঙ্ক, এর পর কী হবে |
|
|
|
|
|