|
|
|
|
আজ ফের দুর্যোগের আশঙ্কা |
প্রকৃতির চোখরাঙানিতে আতঙ্ক, এর পর কী হবে
অগ্নি রায় • দেরাদুন |
১৩১, ৫৫০, ৬৮০... ১০০০। গত ক’দিন ধরে এ ভাবেই লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে কেদারে মৃতের সংখ্যা। আজ আচমকা আশঙ্কার পারদও চড়ে গেল একলাফে। শোনা গেল, সংখ্যাটা হয়তো এ বার পাঁচ হাজারও ছাড়িয়ে যাবে।
প্রশ্ন উঠেছে, পাঁচ হাজার প্রাণেই কি থেমে যাবে মৃত্যুর মিছিল? সন্ধে নামতেই আজ ফের আকাশ লাল। মৃত্যুপুরীর নিস্তব্ধতা খানখান করে দিল আতঙ্কে ঘরছাড়া পাখিদের কোলাহল। আবার কি ফুঁসে উঠবে আকাশ-নদী? প্রহর গুনছেন বানভাসি উত্তরাখণ্ডে বন্দি পর্যটকরা। আতঙ্কিত জওয়ানরাও। এর মধ্যেই চলছে উদ্ধারকাজ।
এমনিতেই সকাল থেকে আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি টের পাইয়ে দিচ্ছিল, গতিক সুবিধের নয়। আবহবিদদের ভবিষ্যদ্বাণী মেনেই সকালে হালকা বৃষ্টি নেমেছিল দেরাদুন ও জোশীমঠ এলাকায়। মেঘে ঢেকে গিয়েছিল পাহাড়, দৃশ্যমানতা ছিল না বললেই চলে। ফলে ওড়েনি হেলিকপ্টার। উদ্ধারকাজ শুরু হয় ঘণ্টা কয়েক পরে, আকাশ কিছুটা পরিষ্কার হলে। মৌসম ভবন সতর্ক করে দিয়েছে, কাল থেকে বৃষ্টির বেগ আরও বাড়বে। আতঙ্ক একটাই, ফিরে আসবে না তো ১৫ জুনের বিভীষিকা? সে আশঙ্কা উস্কে দিয়ে সন্ধে গড়াতেই অঝোর বৃষ্টি নামল দেরাদুনে। কেদার অবশ্য তখনও শান্ত। |
|
শিশুকোলে নদী পেরোনো। রবিবার গোবিন্দঘাটে। ছবি: এএফপি |
এখনও ১৯ হাজার লোক আটকে রয়েছেন দেবভূমির নানা প্রান্তে। আজ থেকে আইটিবিপি-র জওয়ানরা ধস সরিয়ে রাস্তা তৈরি করা শুরু করেছেন। মানে, লোক চলাচলের জন্য যেটুকু তৈরি না করলেই নয়। গত কয়েক দিন ধরে বারবার অভিযোগ উঠছিল, বদ্রীনাথে যে হেতু তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, তাই সেখানে আটকে পড়া ১৫ হাজার পুণ্যার্থীর কথা কেউ ভাবছে না। আজ আইটিবিপি-র ডিআইজি অমিত প্রসাদ জানান, বদ্রীনাথের কাছে একটা কাজ চলার মতো উপযোগী পথ তৈরি করা হচ্ছে। যাতে হাঁটা পথে হলেও পর্যটকদের নামিয়ে আনা যায়। অমিত বলেন, “আবহাওয়া খারাপ থাকলে হেলিকপ্টারে উদ্ধারকাজ এক রকম অসম্ভব। তাই আকাশপথের উপর নির্ভরতা কমাতেই হাঁটা পথের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। মানা আউটপোস্টে রাস্তা তৈরি করছেন আইটিবিপি-র দু’শো জওয়ান।” উত্তরাখণ্ডের বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের অন্যতম কর্তা পীযূষ ভরদ্বাজ অবশ্য বলছেন, “বদ্রীনাথের এমন সব এলাকায় এখনও লোক আটকে রয়েছেন, যেখানে হেলিকপ্টার নামতে পারছে না। আর ওঁদের অনেকেই এত বয়স্ক ও দুর্বল, অনেকেই এত অসুস্থ যে
ওঁদের পক্ষে হেঁটে নেমে আসার সম্ভাবনা কম।’’
মূলত তিনটি সেক্টর ভাগ করে নিয়ে শুরু হয়েছে রাস্তা তৈরির যুদ্ধ। কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, গঙ্গোত্রী। কেদারনাথের পর্যটকদের জন্য গুপ্তকাশী পর্যন্ত রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে। বদ্রীনাথের জন্য জোশীমঠ এবং গঙ্গোত্রীর জন্য উত্তরকাশী পর্যন্ত। ওই তিনটি জায়গা পর্যন্ত পর্যটকদের নিয়ে আসা গেলে সহজেই উদ্ধার করা যাবে তাঁদের।
সহস্ত্রধারা হেলিপ্যাড আর জলিগ্রান্ট বিমানবন্দরটা এক রকম ত্রাণশিবিরের চেহারা নিয়েছে। কাতারে কাতারে লোক। চপারে করে মূলত প্রবীণদেরই আগে আনা হচ্ছে। যদিও অনেকের অভিযোগ, বাস্তবে এমনটা আদৌ হচ্ছে না। মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক জানালেন, গত কয়েক দিন ধরে জঙ্গলের পথ ধরে তিনি টানা
হাঁটছেন। সেনার প্রসঙ্গ উঠতে ধুঁকতে ধুঁকতেই বললেন, “আমার সঙ্গে সত্তরোর্ধ্ব এক প্রবীণ ছিলেন। উনি চোখে দেখতে পান না। কত অনুরোধ করলাম, ওরা কিছুতেই ওঁকে কপ্টারে তুলল না।” এক যুবকের মুখে অবশ্য ঠিক উল্টো কথা, “সেনা যে ভাবে কাজ করছে, ভেবে গর্ব হচ্ছে।”
ছাউনি খাটিয়ে ৩০-৪০টা স্টল বসেছে হেলিপ্যাড চত্বরে। ডাল-পুরির ঢালাও আয়োজন। গত কয়েক দিন ধরে পেটে একটা দানাও পড়েনি। পৌঁছতেই দুর্গতদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে গরম গরম পুরি। সমাজসেবীদের পাশাপাশি রান্নায় হাত লাগিয়েছেন সন্ন্যাসীরাও। কিন্তু খাবে কে? চোখের সামনে যাঁরা আপনজনদের মরতে দেখেছেন, খালি পেটে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে প্রাণ হাতে হেঁটেছেন দীর্ঘ পথ, তাঁদের শরীরে কি খাওয়ার জোরটুকুও আছে? স্থানীয় ডাক্তাররাই যা প্রাথমিক চিকিৎসাপত্র করছেন। আধমরা চেহারাগুলোর কান্না, আর্তি, হাহাকার থেকে থেকে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে কপ্টারের রোটর ব্লেডের ভীমগর্জনে।
এর মধ্যেই মুখে মুখে ঘুরছে মৃত্যুকে সামনে থেকে দেখার নানা কাহিনি। যেমন গোপাল প্রজাপতি। ৫৬-র এই প্রৌঢ় একা হাতে বাঁচিয়েছেন ১১ জনকে। গোপাল। সকলেরই বয়স ষাটের কাছাকাছি। কেদারে যখন চলছে প্রকৃতির তাণ্ডব, তখন সহযাত্রীদের বাঁচানোর প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন গোপাল। হঠাৎ পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসে একটা বড়সড় বোল্ডার। দু’ভাগ হয়ে যায় দলটা। এক দল ছিটকে পড়ে মন্দাকিনীর জলে। তাঁরা তলিয়ে যান চোখের নিমেষে। বাকি ১১ জনকে নিয়ে তার পর থেকেই পাহাড়-জঙ্গল ভেঙে হাঁটছিলেন গোপাল। তিন দিনের মাথায় মৃত্যু হয় এক মহিলা সহযাত্রীর। “আমার কোলে মাথা রেখেই মারা গেলেন উনি। ধাক্কাটা আসলে সইতে পারলেন না”, অস্ফুটে বলে উঠলেন প্রৌঢ়। হেলিপ্যাডের ছাউনিতে সকাল থেকে বসে রয়েছেন রাহুল ত্রিপাঠী। উত্তরপ্রদেশের এই কলেজপড়ুয়া সপরিবার আটকে পড়েছিলেন কেদারনাথ সেক্টরের জঙ্গলচটিতে। তিন দিন পরে সেনা তাঁকে উদ্ধার করে বেহুঁশ অবস্থায়। দেরাদুনের হাসপাতালে জ্ঞান ফিরতে রাহুল জানতে পারেন, ঘটনাস্থলে শুধু তাঁকেই খুঁজে পেয়েছিলেন জওয়ানরা। সেই থেকেই সহস্ত্রধারা হেলিপ্যাডকে ঠিকানা করেছেন রাহুল। কপ্টার নামলেই ছুটে ছুটে যাচ্ছেন। বাবা-মা কি এল? আর বোনটা? |
পুরনো খবর: ছড়ানো দেহের পাশে টাকার বান্ডিল, মৃত্যুপুরী কেদারনাথ |
|
|
|
|
|