ছড়ানো দেহের পাশে টাকার বান্ডিল, মৃত্যুপুরী কেদারনাথ
বিবার রাতে প্রকৃতির প্রথম মারটা সামলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন কেদারনাথে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের কর্মীরা। মহারাজের নির্দেশে যাত্রীদের সরিয়ে ফেলা হয়েছে। জলের তোড়ের সঙ্গে বড় বড় পাথর গড়িয়ে এসে রাতভর কড়া নেড়েছে অতিথি নিবাসের। কেঁপে কেঁপে উঠেছে কংক্রিটের দেওয়াল। বৃষ্টি মাথায় রাত জেগেছেন সবাই। ধীরে ধীরে দিনের আলো ফুটল। সোমবারের মেঘলা সকাল। এ যাত্রা বুঝি রেহাই মিলল বলাবলি করছিলেন সকলে।
আর ঠিক তখনই, নেমে এল মহাপ্রলয়।
প্রথমে একটা ভয়ানক শব্দ।
সে শব্দের গাম্ভীর্য, বিভীষিকা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। পাঁচ দিন মৃত্যু উপত্যকায় কাটিয়ে শনিবার কোনও মতে উখীমঠে ফেরা গৌতম-অর্ধেন্দুরাও তা মানছেন। এঁরা ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের কর্মী। সারা জীবনই হয়তো ওই শব্দ অনুরণিত হবে তাঁদের কানে।
কেদারনাথের মন্দির পেরিয়ে যে রাস্তা উঠেছে, মন্দাকিনী হিমবাহ হয়ে তা গিয়েছে চোরাবারি তাল পর্যন্ত। পাহাড় চুড়োর এই হ্রদে মোহনদাস গাঁধীর চিতাভস্ম বিসর্জন দেওয়ার পর থেকে সেটিকে গাঁধী সরোবর বলেও ডাকা হয়। জলধারণ ক্ষমতা মাত্রা ছাড়ানোর পরে হ্রদটি ফেটে যাওয়াতেই শোনা গিয়েছিল ওই গগন-বিদারী শব্দ।
আজ আগে
—নিজস্ব চিত্র
আর তার পরেই পেছনের আস্ত পাহাড়টা যেন নেমে এসে গিলে ফেলল সব কিছু। ফুট দশেক উঁচু বড় বড় বাড়ি নিমেষে ভিত থেকে উপড়ে এগিয়ে চলল জাহাজের মতো। শঙ্করাচার্যের সমাধি এসে ধাক্কা মারল ভারত সেবাশ্রমের ৪০ ঘরের বিরাট অতিথি নিবাসের পিঠে। সকলকে বার করে দিয়ে স্বামী জগদীশানন্দ মহারাজ তখনও ভেতরে। কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস বার করার চেষ্টা করছেন। রয়েছেন আর এক কর্মীও। তাঁদের কী হল, দেখার সুযোগ পাননি গৌতমরা। শুধু দেখেছেন, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে কয়েকশো ফুট নীচে খরস্রোতা মন্দাকিনীর বুকে তলিয়ে গেল লালচে গেরুয়া রঙের গোটা বাড়িটা।
আতঙ্কে মন্দিরের মধ্যেই আশ্রয় নিয়েছিলেন সকলে। কত ক্ষণ ছিলেন? মনে করতে পারেন না। কত ক্ষণ চলেছিল প্রকৃতির এই তাণ্ডব? তা-ও ঠিক ঠিক বলতে পারেন না কেউ। গৌতম বলেন ঘণ্টাখানেক, তো অপুর ধারণা মিনিট কুড়ি। কিন্তু সেই সময়টাতে তাঁরা যে সাক্ষাৎ মৃত্যুকে সামনে থেকে দেখেছেন, সে ব্যাপারে দু’জনেই একমত।
বাইরে পাথরের দুদ্দাড় দৌড় কমছে। কিছু মানুষ বাইরে বেরিয়েছেন। শোনা যাচ্ছে আর্ত চিৎকার। বৃষ্টি কি একটু কমলো?
বাইরে আসতেই কাদায় ডুবে গেল পা। এত কাদা এল কোথা থেকে? মন্দিরের চাতালটাই বা গেল কোথায়?
পায়ের নীচে থেকে চোখ তুলতেই বুকটা ছাঁৎ করে উঠেছিল অর্ধেন্দুর। মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল। এ কোথায় দাঁড়িয়ে? কেদারনাথ মন্দিরকে ঘিরে ঘিঞ্জি বাজারটা কই? বিড়লা গেস্ট হাউস, ভারত সেবাশ্রম, তার আগে একের পর এক ধর্মশালা। কিছু ক্ষণ আগেও তো এখানেই ছিল সব। কোন এক ভোজবাজিতে যেন নিমেষে হারিয়ে গিয়েছে। স্রেফ মুছে গিয়েছে। খাঁ খাঁ উপত্যকায় শুধু মাথা তুলে দাঁড়িয়ে কেদারনাথের মন্দির। এক্কেবারে একা। আর তাকে ঘিরে ছড়িয়ে রয়েছে সার সার মৃতদেহ। বাচ্চা-বুড়ো-মেয়ে-মরদ। যেন এই মাত্র শেষ হয়েছে কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধ।
বেঁচে রয়েছেন কী করে, বুঝতে গায়ে চিমটি কাটতে হয়নি। কারণ তার আগেই পিঠে পড়েছে পরিচিত হাত। একে একে বেরিয়ে এসেছেন গৌতম-অর্ধেন্দু। ওই তো অপু মাহাতো! ও-পু-উ!
কিন্তু মহারাজ কোথায়? স্বামী জগদীশানন্দ? গৌতমরা আঁতি-পাতি করে খুঁজেছেন। পাননি। তবে কি...?
উখীমঠের সুধীর মহারাজ বলছেন, “অনেক চেষ্টা করেও কোনও খোঁজ মেলেনি। তবে আশায় বুক বেঁধে আছি, কত অলৌকিক ঘটনাও তো ঘটে!”
আরও এক কর্মী নিখোঁজ। শেষ সময় পর্যন্ত তিনিও ছিলেন জগদীশানন্দ মহারাজের সঙ্গে।
শুধু তিনি কেন, গৌরীকুণ্ডের দুই মহারাজ স্বামী কেদারানন্দ ও স্বামী সর্বলোকানন্দজি...। শেষ সময় পর্যন্ত তাঁরা যাত্রীদের ধাক্কা মেরে মেরে নিরাপদ জায়গায় পাঠিয়েছেন। তত ক্ষণে দেওয়াল ভেঙে গ্যালন গ্যালন জল সর্বস্ব ভাসিয়ে দিচ্ছে। তার পরেই চুর-চুর হয়ে গিয়েছে গৌরীকুণ্ডের বিশালাকায় আট তলা অতিথি নিবাস। উখীমঠে ভারত সেবাশ্রম স্কুলের অধ্যক্ষা চন্দ্রিমা সরকার জানিয়েছেন, আজও খোঁজ মেলেনি তাঁদের!
সোমবারের পরে পাঁচ-পাঁচটা দিন ধরে মৃত্যু উপত্যকা থেকে বেরোনোর চেষ্টা করেছেন গৌতমরা। কেদারনাথের মন্দিরেও আর থাকা যায়নি। অজস্র আহত যাত্রী সেখানে চোখের সামনে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন। কারও কিচ্ছু করার নেই। পায়ে পায়ে শুধু দেহ আর দেহ।
মরা মানুষের পাশে তাড়া তাড়া নোটের বান্ডিল। একশো-পাঁচশো, রয়েছে হাজারের বান্ডিলও। ভিজে একসা সে টাকা থেকেও কোনও কাজে লাগছে না।
কোথা থেকে এল এত নোট? আগের দিনই একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে তোলা হয়েছিল কয়েক কোটি টাকা। ব্যাঙ্কের বাড়িটা মুছে গিয়েছে। প্রকৃতির মারে ভল্টও চুরমার। মন্দাকিনীর তোড়ে ভেসে গিয়েছে কোটি কোটি টাকা! জল নামায় আটকে রয়েছে এখানে-ওখানে। সন্ত্রস্ত মানুষ দেখেও দেখছেন না। খাঁচায় আটকে পড়া পশুর মতো তাঁরা তখন রাস্তা খুঁজছেন, মৃত্যুপুরী থেকে বেরোনোর রাস্তা। উত্তর থেকে ধস নেমে গড়িয়ে গিয়েছে দক্ষিণে। মানুষ দল বেঁধে আশ্রয় নিচ্ছেন পুব আর পশ্চিমের পাহাড়ের গায়ে। জঙ্গলের ফাঁকে। মৃতদেহ দেখে দেখে গা গুলিয়ে উঠছে। তাই বোধহয় খিদে পাচ্ছে না কারও। মাঝে মাঝে বৃষ্টি এসে চুপচুপে করে দিয়ে যাচ্ছে। গায়ের পোশাক শুকোচ্ছে গায়েই।
ডান দিকের জঙ্গলের পথ কি বাইরে গিয়েছে? বুধবার সে রাস্তা ধরেই চলতে শুরু করেন গৌতমরা। কয়েক কিলোমিটার গিয়ে রাস্তা মুখ থুবড়ে নেমে গিয়েছে সেই মন্দাকিনীতেই। হতাশ হয়ে ফিরে আসা।
জলের তোড়ে ভেঙে গিয়েছে রাস্তা। ধারালিতে। ছবি: পিটিআই
বৃহস্পতিবার মনে হল ফের একটা শব্দ শোনা যাচ্ছে। টানা গোঁ-গোঁ শব্দ। সমস্বরে কান্নাকে ছাপিয়ে ক্রমেই যেন স্পষ্ট হচ্ছে। জংলা ছাপ চপার একটা। পাক খাচ্ছে আকাশে। যে যেখানে ছিল সবাই বেরিয়ে এল। চলছে হাত নাড়া। ক’টা প্যাকেট পড়ল। খাবারের প্যাকেট। জলের পাউচও।
চপারটা কি নামছে?
নাঃ। বেশ কয়েক বার পাক খেয়ে ফিরে গেল সেটা। লোকের তুলনায় অতি সামান্য খাবার। গৌতমরা শুক্রবার সকালে বাঁ দিকের পাহাড়টার পথ ধরলেন। বহু লোক চলেছে সে পথ ধরে। অনিশ্চিত যাত্রা। এ বার একেবারে অন্য এক অভিজ্ঞতা। কিছু বাইরের লোক ছিনতাই করছে। অসুস্থ যাত্রীদের মারধর করে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে টাকাকড়ি-আংটি-ফোন।
এই বিপর্যয়ের মধ্যেও চুরি-ছিনতাই!
শুক্রবারের রাস্তাও শেষ হল খাদে। গৌতমরা ফিরে এসে শুনলেন, বারে বারে চপার এসে নেমেছিল মন্দিরের সামনের মাঠে। অনেককে উদ্ধার করে নিয়ে গিয়েছে। খাবার ও জল দিয়েছে। সেনারা আশ্বাস দিয়েছেন, ধৈর্য হারাবেন না। সকলকেই উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে।
শুক্রবার সারা দিনই বেরোনোর পথ খুঁজে ফিরেছেন অর্ধেন্দু-গৌতমরা। সন্ধ্যায় একটি চপারে ওঠার সুযোগ মেলে। অবশেষে উড়ে চলেছে আকাশযান। ধীরে ধীরে দৃষ্টিসীমার বাইরে সরে যাচ্ছে কেদার। এখনও দেখা যাচ্ছে দলা পাকানো দেহগুলো...
গুপ্তকাশীতে চপার যখন নামল, দিনের আলো নিভে গিয়েছে। কোথায় যাবেন তাঁরা? পাহাড়ের তীক্ষ্ন ঢাল নেমে গিয়েছে মন্দাকিনীতে। উল্টো দিকে উখীমঠ। সেখানে আশ্রম রয়েছে ভারত সেবাশ্রমের। নীচে একটা পুল আছে ওঁরা জানেন। কিন্তু সে পুলও যে ভেসে গিয়েছে, তা বোধ হয় জানা ছিল না তাঁদের।
অন্ধকারে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন অপু। কোথাও কোনও পাহাড়ের খাঁজে আটকে রয়েছে পা। বাকিরা টেনে তুলতে তিনি উঠলেন, কিন্তু গোড়ালির হাড় খুলে নেমে গিয়েছে। যন্ত্রণা ছাপিয়ে উদ্বেগ, আর তো হাঁটতে পারবেন না অপু! কোনও ক্রমে কাঁধে তুলে নদীর ধারে।
রাত সাড়ে বারোটার সময়ে স্থানীয় কিছু লোক এসে উখীমঠে খবর দেন সুধীর মহারাজকে। কয়েক জনকে নিয়ে নেমে যান তিনি। প্রায় দেড় হাজার ফুট সটান উৎরাই। গাঁয়ের মানুষ পেরোনোর জন্য একটা দড়ির সেতু গড়েছিলেন। জলের তোড়ে সেটা ডুবে গেলেও ভেসে যায়নি। সেটাই ভরসা। নদী পার করে অপুকে তুলে নিয়ে আসা হল কাঁধে করে। শনিবার ভোরের আলো তখন ফুটছে একটু একটু করে।
অবশেষে উখীমঠে স্বজনদের কাছে ছ’জন।

এই সংক্রান্ত আরও খবর...

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.