নদীখাত সংস্কারে মাটি কাটতে সরকারি খরচের যে হিসাব রয়েছে তার চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি টাকা জোড়াপানি নদী সংস্কারে খরচ হয়েছে বলে সন্দেহ করছেন এসজেডিএ-এর অফিসার-কর্মীদের একাংশ। ঘটনাচক্রে, ওই কাজ করিয়েছে এসজেডিএ। অথচ মাত্রাতিরিক্ত দরে কোটেশনের মাধ্যমে ৯ কোটি টাকা খরচ করে জোড়াপানি নদীর মাটি কাটা হয় বলে অভিযোগ। প্রায় ৭২ হাজার কিউবিক মিটার মাটি কাটার কথা। ওই বিপুল পরিমাণ মাটি কোথায় ফেলা হয়েছে হদিস নেই।
যেখানে শ্মশানে বৈদ্যুতিক চুল্লি বসাতে টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ পুলিশে অভিযোগ দায়ের হয়েছে, সেখানে জোড়াপানির ঘটনায় যুক্তদের ব্যাপারে পদক্ষেপ করা হচ্ছে না কেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এসজেডিএ-এর বর্তমান চেয়ারম্যান উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব কাজের অভিযোগ খতিয়ে দেখার জন্য পুলিশে অভিযোগ দায়েরের নির্দেশ দেননি কেন তা নিয়ে এসজেডিএ-এর অন্দরে জল্পনা চলছে। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী এ প্রসঙ্গে বলেন, “জোড়াপানি নদী সংস্কারের কাজে অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিশেষজ্ঞ দল তদন্ত করছে। রিপোর্ট পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দুর্নীতিতে কেউ যুক্ত থাকলে যা প্রকাশ্যে আসবেই এবং শাস্তি পেতে হবে। এটা নিয়ে জল্পনার কোনও অবকাশ নেই।”
সেচ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, এ ধরনের কাজে সরকারি ভাবে প্রতি ঘন মিটার মাটি কাটার দর ২২১ টাকা ধার্য করার কথা। তাতে কাটা মাটি নির্দিষ্ট জায়গা থেকে ৫ কিলোমিটারের মধ্যে ফেলা হয়। আরও দূরে তা ফেলতে হলে প্রতি কিলোমিটারের জন্য প্রতি ঘন মিটার মাটির ক্ষেত্রে আরও ১০ টাকা ২৮ পয়সা করে বাড়তি খরচ লাগবে। কোটেশন করে জোড়াপানি নদী সংস্কারের কাজে কাটা মাটি ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ফেলার কথা জানানো হয় ওয়ার্ক ওর্ডারে। সেই মতো অতিরিক্ত ৫১ টাকা ৪০ পয়সা বেশি খরচ লাগার কথা। শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ওই কাজে প্রতি ঘন মিটার মাটি কাটা এবং ফেলার জন্য কী ভাবে ১২৩৭ টাকা দরপত্র দিয়েছে ঠিকাদার সংস্থাকে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এসজেডিএ সূত্রেই জানা গিয়েছে, গত বছর ১২ অক্টোবর ‘কোটেশন’-এর মাধ্যমে জোড়াপানি নদী সংস্কার এবং বাঁধের মেরামতির কাজ দেওয়া হয় শিলিগুড়ির খেলাঘর মোড়ের নন্দিনী কনস্ট্রাকশন এবং ওই সংস্থার কর্ণধারের আত্মীয় হাকিমপাড়ার এক ঠিকাদারকে। মোট কত টাকার কাজ বা বিস্তারিত কিছুই সেখানে জানানো ছিল না। সে ভাবেই কাজ শুরু করে ওই খাতে জানুয়ারি মাসের মধ্যেই প্রায় ৯ কোটি টাকা খরচ হয়।
খেলাঘর মোড়ের ঠিকাদার সংস্থার কর্ণধার বুড়া পাল বলেন, “কত টাকার কাজ হয়েছে। কোথায় মাটি ফেলা হয়েছে তদন্ত হলেই বোঝা যাবে। এ নিয়ে আর কিছু বলতে চাই না।” হাকিমপাড়ার ঠিকাদার শঙ্কর পাল অবশ্য কিছু বলতে চাননি। ওই কাজে মৃগাঙ্কবাবুর পাশাপাশি এসজেডিএ’র তৎকালীন কার্যনির্বাহী আধিকারিক গোদালা কিরণ কুমারের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। প্রাক্তন কার্যনির্বাহী আধিকারিক এখন কিছু বলতে চাননি।
সরকারি ভাবে ওই বিপুল পরিমাণ অর্থ নয়ছয় করা নিয়ে ঠিকাদার সংস্থা, এসজেডিএ’র দায়িত্বপ্রাপ্ত বাস্তুকার এবং জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ কেন জানানো হচ্ছে না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সিবিআই তদন্তের দাবিও উঠেছে। প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য বলেন, “ওই প্রকল্পে বিপুল আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ স্বীকার করেছেন তৎকালীন চেয়ারম্যান রুদ্রনাথ ভট্টাচার্য। অথচ তার পরেও পুলিশে অভিযোগ জানানো হয়নি। আমরা উচ্চ পর্যায়ের তথা সিবিআই তদন্তের দাবি করছি।” বর্তমান কার্যনির্বাহী আধিকারিক শরদ দ্বিবেদী বলেন, “ওই সমস্ত অভিযোগ তদন্ত করে দেখার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শ্মশানে বিদ্যুতিক চুল্লি বসানোর কাজে অভিযুক্ত এসজেডিএ’র বাস্তুকার মৃগাঙ্কমৌলি সরকার ওই কাজেও যুক্ত বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রাক্তন চেয়ারম্যান রুদ্রনাথ ভট্টাচার্য সেকারণেই জলপাইগুড়িতে বদলি করেছিলেন বলে জানিয়েছেন। তাঁর পদাবনতি এবং পরে সাময়িত ভাবে বরখাস্ত করা হয়। বর্তমানে মৃগাঙ্কবাবু পুলিশ হাজতে। জোড়াপানি সংস্কারের ব্যাপারে রুদ্রবাবু বলেন, “ওই কাজের ব্যাপারে সম্পূর্ণ অন্ধকারে ছিলাম। কী ভাবে ওই দর ঠিক করা হয়েছে সে সব বিস্তারিত তদন্ত করে দেখতে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রীকে জানিয়েছিলাম।”
|