আবাসন দুর্নীতির অভিযোগে প্রাক্তন মন্ত্রী গৌতম দেবকে দু’ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করল সিআইডি। গৌতমবাবুর মতো সিপিএমের প্রথম সারির নেতাকে দুর্নীতির অভিযোগে জেরার মুখে ফেলার ঘটনাকে পঞ্চায়েত ও লোকসভা ভোটের আগে নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক ভাবে হাতিয়ার করতে চাইবে শাসক দল। পাল্টা চাল হিসাবে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গৌতমবাবু সিআইডি-কে শংসাপত্রই দিয়েছেন! তবে হুঁশিয়ারি দিতে ছাড়েননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
রাজ্য গোয়েন্দা সদর দফতর ভবানী ভবনে শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত সিআইডি-র স্পেশাল সুপারিন্টেন্ডেন্ট (দক্ষিণ) রাজেশ যাদবের ঘরে প্রাক্তন আবাসনমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। দক্ষিণ শহরতলির মহেশতলার যোত-শিবরামপুর ও পারুই মৌজায় ১৯৯৩ সালে এক সমঝোতাপত্র অনুযায়ী প্রায় ৪৫ একর জমি অধিগ্রহণ করেছিল আবাসন দফতর। অভিযোগ, প্রায় ১২ বছর পরে বিনা টেন্ডারে বাজার থেকে কম দামে গ্রিনফিল্ড নামে একটি আবাসন সংস্থাকে ওই জমি হস্তান্তর করা হয়। ওই সংস্থার সঙ্গে আবার প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর ছেলে চন্দন বসুর নাম জড়িত। রাজ্যে পালা বদলের পরে এ বছর এপ্রিল মাসে রাজ্য আবাসন দফতরের সচিব তালতলা থানায় গৌতমবাবু-সহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। ওই জমি হস্তান্তরের বিষয়ে অযথা দেরি করায় বেশ কয়েক কোটি টাকা রাজ্য সরকারের লোকসান হয়েছে বলে করা হয়। |
ভবানী ভবনের সামনে গৌতম দেব। |
ওই বিষয়ে এ দিন গৌতমবাবুকে প্রায় ৩৮টি প্রশ্ন করা হয়েছে বলে সিআইডি সূত্রের খবর। এক গোয়েন্দা কর্তা বলেন, “ওই জমির হস্তান্তরের বিষয়ে ২৬টি প্রশ্ন তৈরি করা হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদের সময় প্রাসঙ্গিক ভাবে প্রশ্ন সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বেশ কিছু প্রশ্ন গৌতমবাবু এড়িয়ে গিয়েছেন।” তবে ওই জমি হস্তান্তরের বিষয়ে কোনও বেনিয়ম হয়নি বলে তদন্তকারীদের জানিয়েছেন গৌতমবাবু। সিআইডি সূত্রের বক্তব্য, মোট ৭টি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন প্রাক্তন মন্ত্রী। মূলত ১৯৯৩ সালের সমঝোতা কেন অনুসরণ করা হয়নি, তা-ই গৌতমবাবুর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। তিনি সিআইডি কর্তাদের বলেছেন, ওই বিষয়ে তাঁরা আবাসন দফতরের অফিসারদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন। তবে গৌতমবাবুর মতো প্রাক্তন মন্ত্রীর জিজ্ঞাসাবাদে কোনও সিনিয়র আইপিএস অফিসার না-থাকায় প্রশাসনের একাংশেই কিছু প্রশ্ন উঠেছে।
সিপিএম অবশ্য গোটা ঘটনাকে শাসক দলের ‘প্রতিহিংসার রাজনীতি’ হিসাবেই দেখছে। দলের নেতাদের ফাঁসানোর চেষ্টাকে তারা যে রাজনৈতিক ভাবেই মোকাবিলা করবে, সেই বার্তা দিতে এ দিন ভবানী ভবনের বাইরে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং কলকাতার কর্মী-সমর্থকদের জমায়েত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আলিমুদ্দিন। গৌতমবাবুর জেরা চলাকালীন তাঁরা আগাগোড়া বাইরে বসে সরকার-বিরোধী স্লোগান দিয়ে গিয়েছেন। গৌতমবাবুর সঙ্গে দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা সিপিএম সম্পাদক সুজন চক্রবর্তী যেমন ভবানী ভবনে এসেছিলেন, তেমনই বাইরের জমায়েতে ছিলেন মহম্মদ সেলিমের মতো নেতা থেকে শুরু করে নেপালদেব ভট্টাচার্য, তড়িৎ তোপদার-সহ উত্তর ২৪ পরগনার নেতারা। তাঁদের উপস্থিতি থেকে বার্তা একটাই যে, গোটা দল গৌতমবাবুর পাশে আছে। |
শুক্রবার সেখানেই সিপিএমের জমায়েত। |
জিজ্ঞাসাবাদ শেষে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে গৌতমবাবু বলেছেন, “সিআইডি অফিসারেরা খুব ভাল ব্যবহার করেছেন। ওঁদের সঙ্গে গল্প করলাম। চা খেলাম, কথা বললাম, বেরিয়ে এলাম! আসলে মুখ্যমন্ত্রী চেয়েছিলেন, আমাকে দু’ঘণ্টা ভবানী ভবনে বসিয়ে রাখতে হবে! তাই সিআইডি ডেকেছিল।” তাঁকে নিশানা করা হল কেন? গৌতমবাবুর মন্তব্য, “আমার সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রেম-ভালবাসার সম্পর্ক! আগে ফোন করতাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা হত। এখন সিআইডি-র চিঠি পাঠালেন!” তবে রসিকতার এই মোড়ক রেখেও সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক তথা কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বলতে ভোলেননি, “এ সব করে ওঁদের কোনও সুবিধা হবে না। বাকি তিন বছর এই রকম আরও কিছু তদন্ত করতেই কেটে যাবে। সারদা-কাণ্ডে মুকুল রায়কে কেউ ডাকল না। আর চিঠি পাঠানো হল সুজনকে! এর ফল এক দিন মমতাকে বুঝতে হবে!”
প্রসঙ্গত, কোচবিহারে এক তৃণমূল সমর্থকের মৃত্যুর ঘটনায় তাঁদের দলের জেলা সম্পাদকের নামে যে ভাবে এফআইআর করা হয়েছে, সেই সূত্র ধরে বাম শরিক ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষও এ দিন বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, “যে কারণে উদয়ন গুহকে কোচবিহারে জেলবন্দি করার ষড়যন্ত্র চলছে, সেই কারণে গৌতম দেব, সূর্যকান্ত মিশ্রদের আটক করার ফন্দি করছেন মমতা! পশ্চিমবঙ্গে এ জিনিস চলবে না!”
যে আবাসন দুর্নীতি নিয়ে প্রাক্তন মন্ত্রীকে সিআইডি জিজ্ঞাসাবাদ করছে, সেই ঘটনায় কোনও বেনিয়ম হয়নি বলেই তাঁর দাবি। তিনি জানিয়েছেন, ৮ কোটি টাকার জমি ১৬ কোটিতে বিক্রি করা হয়েছে। লোকসানের প্রশ্ন নেই। তৃণমূলকে চ্যালেঞ্জের সুরে তাঁর আরও দাবি, “মমতা সিপিএমের ১০ জন নেতার নাম বলুন। টাকাপয়সা, বিষয়-সম্পত্তি কাগজের প্রথম পাতায় বেরোবে। আমরা তৃণমূলের ১০ জনের নাম বলব। তাঁদের কথা দ্বিতীয় পাতায় বেরোবে। সাহস থাকলে ওঁরা হিসেব দিন!”
সকাল ১০টা থেকেই এ দিন ভবানী ভবন ও প্রেসিডেন্সি জেল সংলগ্ন এলাকায় সিপিএম সমর্থকেরা জমায়েত শুরু করেন। র্যাফ, কমব্যাট ফোর্স ও মহিলা পুলিশ-সহ বিশাল বাহিনী নিয়ে আয়োজনে খামতি রাখেননি পুলিশ-কর্তারাও। গৌতমবাবুরা বেরিয়ে যাওয়ার পরে এক দল এসএফআই সমর্থক মিছিল করে হাজরা মোড়ের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে ডিসি (সাউথ) বিশাল গর্গের নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনী তাদের আটকায় বলে অভিযোগ। কতর্ব্যরত এক পুলিশ-কর্তা বলেন, “কালীঘাট সেতু লাগোয়া মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি। সেই কারণে আগাম অনুমতি ছাড়া মিছিল করায় আইনগত বাধা রয়েছে।” পুলিশ-কর্তাদের সঙ্গে আলোচনার পরে ভবানী ভবন থেকেগোপালনগর মোড় পর্যন্ত মিছিল করে এসএফআই। |