অঞ্জন-ব্যঞ্জন
পোস্তর পাতেখড়ি
মোহনবাগানের সব কিছু খারাপ, এমন কট্টর ইস্টবেঙ্গল আমি নই। যেমন চিংড়ি, যেমন পোস্ত। চিংড়ি অন্য একদিন হবে, আজকে গল্প হোক পোস্ত নিয়ে। এ এমন একটা উপাদেয় উপাদান যে নামের আগে যা খুশি বসান, দিব্যি একটা রান্নার আদল নেবে। আলু, ঝিঙে, পটল, বেগুন, শিম এমন কি ডিম, পোস্তর গুণে নুন দিতে নেই।
পশ্চিমবাংলার এই একটি পদে ঘটি-বাঙাল এককাট্টা। কোথায় লাগে পকেট-খালি করা সব আমিষ পদ? ভাবুন, এ রকমই এক শনিবারের দুপুরবেলা, বাইরে লাখো ওয়াটের সূর্যের দাপট, ঘরের ভিতর আপনি, আলুপোস্ত আর বিউলির ডাল...গরম এক নিমেষে ঠান্ডা! শুধু পোস্তবাটা দিয়ে এক হাঁড়ি ভাত সাবড়ে দিতে পারে এমন লোকও কিন্তু মোটেই দুষ্প্রাপ্য নয়। পোস্তর বড়া রীতিমতো স্পেশালিটি কুইজিন-এর লিস্টে প্রথম সারিতে।
বর্ধমানের বাসস্ট্যান্ডের কাছে একটি পাইস হোটেল তো, পোস্তর বড়াকে শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে। পোস্ত নিয়ে এ রকম অজস্র ইনোভেশন। আমার এক বন্ধুপত্নী, পোস্তকে আমিষ মোড়কে মুড়ে এমন ডিমপোস্ত বানিয়ে থাকেন, যার রেসিপির জন্য হা-পিত্যেশ করবেন পাঁচতারা হোটেলের শেফেরাও। ভাতের সঙ্গে, রুটির সঙ্গে, লুচির সঙ্গে কি পরোটার সঙ্গে পোস্তর যুগলবন্দি যুগ যুগ জিও। যে ভাবেই রাঁধুন, যে ভাবেই খান, পোস্ত এক ও একমাত্র। বাংলাদেশে এক বার বর্ষায় ইলিশ-পোস্ত খেয়েছিলাম, তার স্বাদ বছরের সব ঋতুতেই মুখে লেগে আছে, আজও। সত্যি কথা বলতে কি, বাংলার পশ্চিমে পোস্তর হাতেখড়ি ঠিকই, কিন্তু তার যথার্থ পাতেখড়ি হয়েছে পূর্ব বাংলাতেই। এ নিয়ে, ঘটি-বাঙাল লড়াই বাধবার আগে পোস্তর আর একটা অ্যাপ থুড়ি, অ্যাপ্লিকেশন পরখ করা যাক।
কথায় বলে না, মোল্লার দৌড় মসজিদ অবধি। আমারও তাই। পৃথিবীর যে কোনও রান্নাকে বাংলার হেঁসেলে না তোলা পর্যন্ত আমার শান্তি নেই। এই সে দিন, বাড়িতে পিৎজা বানিয়ে সবাইকে খাওয়ালাম, টপিংস কী দিলাম বলুন তো, স্রেফ ভাজা পোস্ত! সে যে কী সমাদর পেল, কী বলব। তো, এ রকম নানা ভাবে পোস্তর যে ব্যবহার তা আর কটা মশলায় সম্ভব বলুন।
বাসমতির পেটেন্ট যেমন আমাদের হাতছাড়া হয়েছে, রসগোল্লা হতে হতে বেঁচেছে, আশা করি, পোস্তর রকমারি রান্নার পেটেন্ট অনতি দূরে আমাদের হাতে চলে আসবে। গেঁয়ো যোগী আজ হয় তো পাত্তা পাচ্ছে না, কাল দেখবেন ফরাসি কি ইতালিয়ান রেসিপিতেও হৈ হৈ করে ঢুকে পড়েছে আমাদের ঘরের পোস্ত।
এত ইকনমিক অথচ সুস্বাদু রান্নার উপকরণ হয়ে উঠতে উঠতে পোস্ত চলছে, চলবে। পোস্ত নিয়ে চেনা রেসিপির বাইরে আসুন, এ বার কিছু অপরিচিত রান্নার খোঁজ করি। প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর পোস্ত-ভাতে তেমনই একটি স্বাদু পদ। পোস্ত-ভাতে খেতে হয় লেবু, নুন, কাঁচা লঙ্কা ও সরষের তেল সহযোগে। পোস্তর অম্বল, পোস্ত দানার আমশোল, পোস্ত চচ্চড়ি এমন কি পোস্ত দিয়ে তৈরি বড়ি, সবেতেই পোস্তর জয়জয়কার। আমি তো একটা ছড়াই কেটে ফেলেছি, এই পোস্তকে নিয়ে। আজ যখন বেহিসেবি ইটিং আউটের চোটে বাঙালির ট্যাঁক খালি হয়ে চলেছে ক্রমাগত, তখন এই ছড়াটা মনে রাখলে কাজ হবে। “পকেটে নেই রেস্ত, ঘরে আছে পোস্ত!” বিশ্বায়নমুখী বাঙালিকে ঘরে ফেরানোর একটা ফুসমন্তর আর কি।

ছবি: শুভেন্দু চাকী




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.