ব্যাগ গুছিয়ে... অচেনা ইতিহাসের পথে
টোটোনদার সঙ্গে বেড়ানোর মজাই অন্য রকম। পরিচিত জায়গার ভিতরে এমন অদ্ভুত এক একটা স্পট্ খুঁজে, থুড়ি জেনে রাখে যা শুনলে স্থানীয় লোকজনও একটু থতমত খায়। ভাবে এখানে এমন কী আছে? কেমন বোকা, পয়সা খরচা করে এখানে যেতে চায়। আসলে অধিকাংশ বাঙালির ফি বছরে জমানো পাঁচ টাকার মধ্যে আড়াই টাকাই খরচা হয় বেড়ানোয়। এর মধ্যে কেউ কেউ অল্পচেনা বা অচেনা জায়গায় পৌঁছতে পারলে মনে করেন ‘মার দিয়া কেল্লা’। আর সে জায়গায় যদি থাকে পাহাড়, সমুদ্র, অকৃপণ প্রকৃতি আর ইতিহাসের মিশেল তবে তো ‘জায়গা গরম’ মানে, হটস্পট আর কী। তবে ‘হটস্পট’ না হলে কি কেউ গোটা পাহাড়টাই কিনে কোটি কোটি টাকা খরচ করে একটা ঝক্কাস ফিল্ম স্টুডিও বানায়।
ভাইজাগ বা স্থানীয়দের অতি প্রিয়, আদরের ‘বিশাখা’র (বিশাখাপত্তনম) ঝাঁ-চকচকে মেরিন ড্রাইভ। বাঁ দিকে লাগাতার সি ফেসিং বহুতল। এ বলে আমায় দেখ ও বলে আমায়। ডান দিকে নীল সমুদ্রের উচ্ছ্বাসকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের চার চাকা সাঁই-সাঁই করে এগিয়ে চলেছে ‘সীমাচলমের’ দিকে।
দেওয়ালির পরে এখানে আবহাওয়া পাল্টে যায়। কড়কড়ে রোদ কিন্তু উত্তাপ কম। সমুদ্র-হাওয়ায় এতটুকু আঁশটে গন্ধ নেই। আছে দিক্চক্রবাল জুড়ে শুধুই জাহাজের আনাগোনা। কলকাতা থেকে প্রায় হাফ ডজন ট্রেনের যে কোনও একটায় চেপে পড়লে চোদ্দো ঘণ্টার মধ্যেই হাতের মুঠোয় এক অন্য প্রকৃতি। রামকৃষ্ণ বিচে ‘কুরসুরা’ সাবমেরিনে অনেকটা সময় কাটিয়ে সবে ‘ভুডা পার্ক’ পেরিয়ে যাচ্ছি, টোটোনদা ড্রাইভারকে বলল, ‘আভি থোটলাকোন্ডা যায়েঙ্গে।’ ব্যস, ড্রাইভার সাহেবের কোঁচকানো নাক আরও ছোট হয়ে গেল, ‘হান্ডে’ না ‘ইন্ডে’ কী একটা বলে গাড়ির গতি দিল কমিয়ে। নিজের ভাষার সঙ্গে এবড়ো-খেবড়ো হিন্দি মিশিয়ে কেমন আর্তনাদ করে উঠল। ‘সীমাচলম নহি?’ টোটোনদা বলে উঠল, ‘চলম, চলম। আগে ওই পাহাড়ের উপর চলম, যাঁহা পর বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি আর নীচে নীল লহরম পশ্যন্তি’। ‘খাইছে’ বলে কে যেন গাড়ির পেছন থেকে খ্যাঁক করে হেসে উঠল আর ড্রাইভারও কেমন ভ্যাবাচাকা খেয়ে দিল গাড়ির গতি বাড়িয়ে।
ভাইজাগ শহর থেকে ১৯ কিমি পথ। প্রথম পাহাড়টিতে আধুনিক চমক! ফিল্ম স্টুডিও। অপূর্ব সব মিনিয়েচার। সাজানো উদ্যান, দোকান, বাড়ি, অফিস, জেলখানা মোদ্দা কথায় ছোটখাটো একটা শহর ও গ্রামকে কায়দা করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে উপত্যকার নানান জায়গায়। সমুদ্রকে এমন ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে না দেখলে ভাবা যায় না। দক্ষিণের সুপারস্টারদের তো বটেই, মায় যে সব বলিউড মাল্টিস্টাররা এখানে শ্যুটিং করে গিয়েছেন তাঁদের ছবিও এখানে টাঙানো। প্রকৃতিকে এখানে যেন মডার্ন টেকনোলজি দিয়ে ‘কাট-কপি-পেস্ট’ করা হয়েছে।
আধুনিকতার টাইম মেশিন থেকে ব্যাক গিয়ার দিয়েই সামনে সম উচ্চতার দ্বিতীয় পাহাড়ে চললাম প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী হতে। বৌদ্ধ স্তূপের আদলে তৈরি এক অপূর্ব গেট পেরিয়ে, একা নীল সাগরকে রাস্তার ধারে রেখে গাড়ি উঠতে লাগল আঁকা-বাঁকা পথ ধরে। ছোটখাটো কয়েকটা হেয়ারপিন বেন্ড টপকে ফুলের সাম্রাজ্যের ভিতর দিয়ে গাড়ি থামল নীল আকাশের কোলে। জলছোঁয়া সমুদ্র থেকে এখানকার উচ্চতা প্রায় ছ’শো ফুট। এলোমেলো দুরন্ত হাওয়ায় সামনের সবুজ উপত্যকা জুড়ে শুধুই বাতাসের ফিসফিসানি রোমাঞ্চ। চারিদিকে বনজ লতার গন্ধে আদিম স্পর্শ। এখানে শুধুই আমরা ক’জন। আচমকা নির্জনতা ভাঙে মাথার উপরে এক সামুদ্রিক ঈগলের তীক্ষ্ণ চিৎকারে। চক্রাকারে সে নেমে আসে দুরন্ত গতিতে, বসে পড়ে বৌদ্ধ ধ্বংসস্তূপে লাগানো একটা ফলকের উপর। ঠোঁটে ঝুলছে সদ্য শিকার করা একটা সাপ। ফলকের উপর লেখা ‘ওয়েলকাম টু থোটলাকোন্ডা’। টোটোনদার ঠোঁটে বাঁকা হাসি। ‘থোটলা’ মানে পাহাড়, ‘কোন্ডা’ মানে জলাধার। এক কথায় ‘পাহাড়ি জলাধার’।
অনেক আগে আকাশপথ থেকে প্রথম দেখা যায় এই বৌদ্ধবিহার। ১৯৮৮ সালে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া অধিগ্রহণ করে জায়গাটি। এই অঞ্চল খনন করে পাওয়া যায় একটি মহাস্তূপ। শোনা যায় ধর্মপ্রচারে সিংহল যাওয়ার পথে স্বয়ং বুদ্ধদেব ও বৌদ্ধ শ্রমণরা এখানে বিশ্রামে ছিলেন বহু দিন। প্রকৃতি এখানে অপার। একদম নীচে তালগাছের ফাঁকে ফাঁকে বিস্তীর্ণ সমুদ্র সফেদ ফেনা ওগরাচ্ছে হলুদ বালুতটে। অবাক বিস্ময়ে, নীচের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নেশা ধরে যায়। ভাবলেও অবাক হতে হয় সেই সময়ে অরণ্য-আকীর্ণ দুর্গম পাথুরে এই জায়গায় কী তৈরি করেছেন তাঁরা। আমাদের গাইড জানালেন, এই থোটলাকোন্ডার জমা জলেই চাষ হত ভেষজ লতাগুল্ম ও শাকসব্জির। মূল জলাধার থেকে জল নিয়ে ১১টা কৃত্রিম জলাধারে সঞ্চয় করা হত। প্রয়োজনে তা কাজে লাগানো হত। এক বিন্দু জলের অপচয়কে অপবিত্রতা বলে গণ্য করা হত। সযত্নে রক্ষিত সেই সময়কার ইট, রাস্তা, স্থাপত্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ পেতে হলে গাইড আবশ্যক, না হলে সজীব রঙিন এই প্রকৃতির পাশে বর্ণময় নীরব-ইতিহাসকে বড় নির্জীব মনে হবে। থ্যাঙ্ক ইউ টোটোনদা, থোটলাকোন্ডার জন্য তোমায় দশে আট দিতেই হবে।

কী ভাবে যাবেন
করমণ্ডল, ফলকনামা, ইস্ট কোস্ট-সহ নানা ট্রেন যাচ্ছে ভাইজাগ
বা বিশাখাপত্তনম হয়ে। সেখান থেকে সিটি বাস বা প্রাইভেট গাড়িতে।
কোথায় থাকবেন
ভাইজাগে প্রচুর হোটেল আছে।
কখন যাবেন
সেরা সময় অক্টোবর থেকে মার্চ।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.