একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের লোকেরা বাইকে চেপে ঘুরে বেরাচ্ছে গ্রামে। তারা তাদের বিরোধী-প্রার্থী এবং ভোটারদের হুমকি দিচ্ছে। প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা বাহিনী না থাকার ফলেই এমন ঘটনা ঘটছে।
কোনও বিরোধী দলের অভিযোগ নয়। রাজ্য নির্বাচন কমিশন বৃহস্পতিবার কলকাতা হাইকোর্টে যে স্টেটাস রিপোর্ট জমা দিয়েছে, তাতে এমন কথাই বলা হয়েছে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের বর্তমান অবস্থা কী, তা জানতে চেয়ে কমিশনকে ওই রিপোর্ট জমা দিতে বলেছিলেন হাইকোর্টের বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্রদেশ কংগ্রেসের তরফে ওই মামলাটি দায়ের করেছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস নেতা তুলসী মুখোপাধ্যায়। তাঁর অভিযোগ ছিল, হুমকি এবং ভয়ে তাঁদের অনেক প্রার্থী মনোনয়নপত্র পেশ করতে পারেননি। শুধু তাই নয়, যে সব প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, তাঁদেরও অনেকেই এলাকা ছাড়া। নানা ভাবে হুমকি এবং ভয় দেখানো হচ্ছে তাঁদের। পুলিশের কাছ থেকেও ওই প্রার্থীরা নিরাপত্তা পাচ্ছেন না। সব প্রার্থীকে নিরাপত্তা দেওয়ার দাবি জানানো হয় ওই মামলায়।
মামলাটির শুনানির সময় বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন তোলেন, মনোনয়ন ও প্রচার পর্বে যদি নিরাপত্তার অভাব দেখা দেয়, তা হলে ভোটের দিন কী হবে? ভোটকে একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বলে মন্তব্য করে বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া, প্রচার সঠিক ভাবে হলে তবেই ভোট হওয়ার কথা। |
স্টেটাস রিপোর্ট কমিশনের |
হাইকোর্টে কমিশন |
আইনশৃঙ্খলা নিয়ে |
• মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা
• রাজনৈতিক সংঘর্ষ চলছে, মৃত্যু ৫ জনের
• বাইক-বাহিনী গ্রামে গিয়ে হুমকি দিচ্ছে |
নিরাপত্তা বাহিনী নিয়ে |
• মনোনয়ন-পর্বে চাওয়া হয় ৩২,০০০ পুলিশ
• রাজ্য দিয়েছে ৩,৮৮৩ পুলিশ
• প্রচার পর্বে চাওয়া হয় ৩২,১০০ পুলিশ
• রাজ্য জানায়, আগে এত বাহিনী দেওয়া হয়নি
• কত বাহিনী পাওয়া যাবে জানায়নি রাজ্য
• তিন দফা ভোটের জন্য চাওয়া হয় ২,৪১,৭৬০ পুলিশ
• এ ক্ষেত্রেও কত বাহিনী মিলবে, জানায়নি রাজ্য |
|
তিনি কমিশনকে পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে রাজ্যের বর্তমান অবস্থা জানিয়ে একটি রিপোর্ট জমা দিতে বলেছিলেন। ওই রিপোর্ট দেখে তিনি পরবর্তী নির্দেশ দেবেন বলেও জানান বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায়।
কমিশনের তরফে তাদের সচিব তাপস রায় যে রিপোর্ট এ দিন জমা দিয়েছেন, তাতে বিরোধীদের অনেক অভিযোগই কার্যত মেনে নেওয়া হয়েছে। এ দিন কমিশনের পেশ করা রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাধা এবং হুমকির জন্যই বহু ইচ্ছুক মানুষ এ বারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে মনোনয়নপত্র পেশ করতে পারেননি। রাজ্য সরকার প্রয়োজনীয় বাহিনী দিতে না পারার জন্যই যে ওই বাধা এবং হুমকি অতিক্রম করা যায়নি, সে কথাও রাজ্য নির্বাচন কমিশন এ দিন হাইকোর্টকে জানিয়েছে।
পঞ্চায়েত ভোট ঘিরে যে এমন অশান্তি হতে পারে তার আঁচ পেয়ে গত বছর সেপ্টেম্বর মাসেই যে তাঁরা রাজ্য সরকারকে সতর্ক করেছিলেন বলে এ দিন কমিশনের সচিব তাঁর রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন। রিপোর্টে কমিশন সচিব বলেছেন, ২০১২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর কমিশন পঞ্চায়েত নির্বাচনের জন্য ৮০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় সশস্ত্র বাহিনী দেওয়ার অনুরোধ করেছিল। এর মধ্যে ৩০০ কোম্পানি মনোনয়ন, প্রচার, আস্থা অর্জন, এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় ইত্যাদির জন্য চাওয়া হয়েছিল।
কমিশনের সচিবের অভিযোগ, গত ১৪ মে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশের আগে তাঁদের ওই চিঠির কোনও জবাবই রাজ্য সরকার দেয়নি। ২৪ মে রাজ্য সরকার কয়েকটি রাজ্যের কাছে বাহিনী দেওয়ার জন্য চিঠি লেখে। ২৮ মে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সশস্ত্র বাহিনী চেয়ে চিঠি লেখে রাজ্য। কমিশনের সচিবের জমা দেওয়া রিপোর্টে আরও বলা হয়, মনোনয়ন পর্বে কমিশন যত বাহিনী চেয়েছিল, প্রায় তার কিছুই পায়নি। কমিশন চেয়েছিল ৩২ হাজার পুলিশ। পেয়েছে মাত্র ৩ হাজার ৮৮৩ জন। ফলে যাঁরা মনোনয়নপত্র পেশ করতে ইচ্ছুক ছিলেন, তাঁদের সবাইকে নিরাপত্তা দেওয়া যায়নি। আর তার জেরেই বহু ক্ষেত্রে জোর খাটিয়ে, বাধা দিয়ে মনোনয়ন পেশ আটকানো হয়েছে। ১৯ জুন পর্যন্ত হিসেবে দেখা যাচ্ছে, ৬ হাজার ২৭৪ গ্রাম পঞ্চায়েত আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা জিতে গিয়েছেন।
তাপসবাবুর জমা দেওয়া রিপোর্টে বলা হয়, মনোনয়ন পর্ব শেষ হওয়ার পরে এখন সর্বত্র প্রচার পর্ব শুরু হয়েছে। কমিশন রাজ্য সরকারকে বলেছিল, প্রতি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় পুলিশের এক জন এসআই বা এএসআই ও ন’জন কনস্টেবল দিতে। প্রচার পর্বের জন্য কমিশন ৩২ হাজার ১০০ পুলিশ। গত ১৭ জুন রাজ্য সরকার কমিশনকে জানিয়ে দেয়, প্রচার পর্বে কখনও এত সংখ্যক বাহিনী দেওয়া হয়নি। কিন্তু তারা কত বাহিনী দিতে পারবে, তা কমিশনকে জানায়নি রাজ্য।
তিন দফা নির্বাচনের জন্য কত বাহিনী দরকার গত ১৭ জুন রাজ্যের মুখ্যসচিব, অতিরিক্ত মুখ্যসচিব, রাজ্য পুলিশের ডিজি এবং রাজ্য পুলিশের এডিজি (আইন-শৃঙ্খলা) কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বসে তা জানিয়ে দিয়েছিল কমিশন। কিন্তু সেখানেও রাজ্য সরকার জানাতে পারেনি কত বাহিনী তারা দিতে পারবে। ওই বাহিনী না পেলে যে অবাধ পঞ্চায়েত ভোট করা সম্ভব নয়, তা স্টেটাস রিপোর্টে জানিয়ে দিয়েছেন কমিশনের সচিব।
এ দিন রিপোর্ট পেশের সময় কমিশনের আইনজীবী লক্ষ্মীচাঁদ বিয়ানী বলেন, এই রিপোর্ট তৈরির সময় পর্যন্ত রাজ্য সরকার কত বাহিনী দেবে, তা কমিশনকে জানায়নি। বাহিনী নিয়ে এই দোলাচলের কারণেই মনোনয়ন পর্বে সর্বত্র সঠিক ভাবে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া যায়নি। নিরাপত্তা বাহিনীকে সব এলাকায় নিয়োগ করা যায়নি বলেই এই পর্বে হিংসা ও হুমকির ঘটনা বাড়ছে। এই অবস্থায় সঠিক ভাবে প্রচারের কাজও পরিচালনা করা কমিশনের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।
বিয়ানী বলেন, ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও রাজ্য কত বাহিনী দেবে তা জানতে না পারায়, নির্বাচন কমিশন অবাধ ও মুক্ত ভোটের জন্য যা করার তা করতে পারছে না।
রাজ্যের জিপি অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় আদালতে জানান, আগামী সোমবার বাহিনী নিয়েই প্রধান বিচারপতি অরুণ মিশ্র ও বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চে মামলার শুনানি রয়েছে। তাই বাহিনী নিয়ে এই মামলার শুনানি সোমবারের পরে করা হোক।
বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দেন, আগামী মঙ্গলবার পুনরায় এই মামলার শুনানি হবে। |