পশ্চিমবঙ্গ নারী নিগ্রহে প্রথম। এই পরিস্থিতিকে ধিক্কার জানাতে আজ, শুক্রবার কলেজ স্কোয়ার থেকে মিছিল করবেন রাজ্যের বিশিষ্ট জনেদের একাংশ। তার ২৪ ঘণ্টা আগে সেই কলেজ স্কোয়ারেই শিল্পী-সাংস্কৃতিক কর্মী-বুদ্ধিজীবী মঞ্চ এবং নারী নিগ্রহ বিরোধী কমিটির সভায় ওই প্রতিবাদের সুর খানিকটা বাঁধা হয়ে গেল। যে প্রতিবাদে হাজির থাকলেন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব অপর্ণা সেন, সাহিত্যিক তরুণ সান্যাল, নাট্যব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তী, কৌশিক সেন, গায়ক প্রতুল মুখোপাধ্যায়, চিত্রশিল্পী সমীর আইচ, শিক্ষাবিদ সুনন্দ সান্যাল প্রমুখ। বিগত বাম জমানায় সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-লালগড়-নেতাই কাণ্ডের প্রতিবাদে যাঁদের ধারাবাহিক ভাবে আন্দোলনের রাস্তায় দেখা গিয়েছিল। তাঁরা ছিলেন ‘পরিবর্তনপন্থী’। পরিবর্তনের দু’বছরের মধ্যে ফের তাঁরা রাস্তায়। এ রাজ্যে ক্রমবর্ধমান নারী নিগ্রহের প্রতিবাদে। ওই বিশিষ্টদের এ দিনের বক্তব্যের মূল উপজীব্য ছিল, কী ভাবে আইনশৃঙ্খলা কঠোর করে এবং মহিলাদের ভোগ্য হিসাবে দেখার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলে নারী নির্যাতন ঠেকানো যায়। অপরাধ দমনে পুলিশ-প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসহিষ্ণুতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তাঁরা। অপর্ণা বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী, যাঁকে আমরা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এনেছিলাম, তিনি বিরোধী আসনে থাকাকালে তাঁর অন্য চেহারা দেখতাম। তিনি অসহায়, বিপন্নের পাশে ছুটে যেতেন। দেখে ভাল লাগত। এখন ভাল লাগছে না।” |
অপর্ণার আরও বক্তব্য, “এত অন্ধকারে মেয়েগুলোকে হেঁটে যেতে হয়! রাস্তায় আলো নেই কেন? কলকাতায় যেখানে অনেক আলো, সেখানে ত্রিফলা আলো লাগিয়ে আরও ঝলমল করানো হচ্ছে। অথচ গ্রামের অন্ধকার রাস্তায় আলো দেওয়া হচ্ছে না!” বাম জমানায় শাসক দলের আশ্রয়ে থাকা দুষ্কৃতীরাই এখন দল পাল্টে ক্ষমতা বজায় রেখেছে বলেও অভিযোগ করেন অপর্ণা।
এই প্রেক্ষাপটেই আজ বেলা ৩টেয় কলেজ স্কোয়ার থেকে শুরু হওয়ার কথা বিশিষ্টদের মিছিল। যে মিছিলে থাকার কথা শঙ্খ ঘোষ, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, মৃণাল সেনদের। নন্দীগ্রাম-কাণ্ডের ৬ বছর পরে শঙ্খবাবুকে আবার প্রতিবাদে পথে নামতে দেখা যাবে। তবে এই প্রতিবাদের আবহেও বিশিষ্টজনেদের মধ্যে বিভাজন রেখা রয়েই গিয়েছে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের সময় যাঁরা রাস্তায় নেমেছিলেন, তাঁদের অনেকে এখন দূরে থাকতে চাইছেন। আবার সে দিন যাঁরা প্রতিবাদ করেননি, এখন তাঁদের অনেকে এগিয়ে আসছেন। কলেজ স্কোয়ারে এ দিনের সভাতেও সমস্ত বিশিষ্টের সুর এক ছিল না।
বাম জমানায় সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে যখন সন্ত্রাস এবং ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে, তখন যাঁরা চুপ করে ছিলেন বা তৎকালীন প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন, তাঁদের এখনকার প্রতিবাদ ‘সত্য’ না ‘ভঙ্গি’, সে প্রশ্ন তুলছেন কৌশিকবাবু, বিভাসবাবুরা।
কৌশিকবাবু আগেই জানিয়েছেন, তিনি আজকের মিছিলে যোগ দেবেন না। কারণ, সেখানে এমন অনেকে থাকবেন, যাঁরা বাম জমানায় তৎকালীন প্রতিবাদীদের বিরোধিতা করেছিলেন। কৌশিকবাবু এ দিন বলেন, “আমি অভিনেতা। অভিনেতার কাজ মনে রাখা। আমার যেমন এখনকারটা মনে থাকছে, তেমনই আগেরটাও মনে আছে।” বিভাসবাবু বলেন, “প্রতিযোগিতামূলক প্রতিবাদ বন্ধ করুন। কৌশিকের ওই বক্তব্যের জন্য তাঁকে দোষ দিতে পারি না।” এর বিপরীত মত ব্যক্ত করে তরুণবাবু বলেন, “আমরা যে ওঁকে (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে) মুখ্যমন্ত্রী করার জন্য রাস্তায় নেমেছিলাম, তা অন্যায় হয়েছিল। সে কথা স্বীকার করছি। বাঘের হাত থেকে কুমিরের হাতে গিয়ে পড়লাম আমরা।” সমীরবাবুও বলেন, “যাঁরা আগে প্রতিবাদ করেননি, তাঁদের এখনও প্রতিবাদ করার অধিকার নেই, তা মনে করি না। এমন হলে তো শাসক দলের সুবিধা। বিভাজন দেখে তারা খুশি হবে!” আইনজীবী পার্থ সেনগুপ্ত বলেন, “যাঁরা বাম জমানায় চুপ করে ছিলেন, তাঁরা নিশ্চয়ই এখন মুখ খুলতে পারেন। কিন্তু আগে তাঁদের সেদিনের ভূমিকার জন্য অন্যায় স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে হবে।”
কৌশিকবাবু, বিভাসবাবুরা যাঁদের সঙ্গ এড়াতে চাইছেন, তাঁদের দু’ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি গায়ক শুভেন্দু মাইতি এবং নাট্যব্যক্তিত্ব চন্দন সেন এ দিনের সভায় যোগ দেন। চন্দনবাবু অবশ্য বক্তৃতা করেননি। ছিলেন শতরূপা সান্যাল, মীরাতুন নাহার, কল্যাণ রায়, শাশ্বতী ঘোষ, মানবাধিকার কর্মী সুজাত ভদ্রেরাও।
বিশিষ্টজনেদের মধ্যে যাঁরা এখন তৃণমূলপন্থী বলে পরিচিত, তাঁদের তরফেও ভাবনাচিন্তা চলছে কামদুনির ঘটনার পাশাপাশিই মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ‘কুৎসা’র প্রতিবাদেও পথে নামার। তবে এখনও সেই বিষয়ে কর্মসূচি কিছু চূড়ান্ত হয়নি।
বিশিষ্টদের আজকের প্রতিবাদ কর্মসূচি বিরোধীদের ‘নেতিবাচক রাজনীতি’কে মদত দেবে বলে মনে করছে শাসক দল। বিশিষ্টদের মিছিল না-করার আবেদন জানিয়ে এ দিন তৃণমূলের মহাসচিব তথা রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “নন্দীগ্রাম বা নেতাইয়ের ঘটনার পরে প্রশাসন মানুষের পাশে না দাঁড়ানোর প্রতিবাদ জানিয়ে বিশিষ্টজনেরা পথে নামেন। কিন্তু বারাসত-কাণ্ডে সরকার এগিয়ে এসেছে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং ঘটনাস্থলে গিয়েছেন। অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এক মাসের মধ্যে বিচার করে ধর্ষকদের সরকার ফাঁসির কাঠগড়ায় তুলতে চাইছে, তখন সম্মাননীয় বিশিষ্টজনেদের আর কী দাবি থাকতে পারে!”
তিনি আরও বলেন, “সিপিএম ও বিরোধীরা রাজ্যে অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য হতাশাগ্রস্ত রাজনীতি করছে। বাংলার বিশিষ্টজনেদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই বলছি, এখন তাঁরা পথে নেমে আন্দোলন করলে বিরোধীদের সেই অস্থিরতা সৃষ্টির রাজনীতি মদত পাবে।” |