রাত তখন ১০টা। প্রায় সুনসান রাস্তা। দু’একটা কুকুর চিৎকার করে ডাকছে। হঠাৎই নিস্তব্ধতা ভেঙে গ্রামের গলি থেকে বেরিয়ে এল ১৫-২০টি বাইক। প্রতিটিতে দুই জন। তারা চিৎকার করে গ্রামের রাস্তায় বলছেন, “প্রচারে বেরিয়েছিস, তাহলে ফল ভোগ করতে হবে। আবার আসব।” বাইক আরোহীরা এরপর চলে গেল অন্য গ্রামে। ততক্ষণে আতঙ্ক ছেয়ে গিয়েছে এলাকায়।
আরোহীরা সকলেই ‘বাইক বাহিনী’র সদস্য। সন্ধ্যার পর প্রচারের দায়িত্ব মূলত এদের হাতেই।
কি ডান, কি বাম কোচবিহারে সব পক্ষই ‘বাইক বাহিনী’কে পথে নামিয়ে পঞ্চায়েত দখল করার চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধেই অভিযোগ বেশি। গত শনিবার কোচবিহারের দিনহাটায় খট্টিমারিতে নরেশ বর্মন (৩২) নামে যে তৃণমূল কর্মী খুন হন সেখানেও বাইক বাহিনীর দৌরাত্ম্যের অভিযোগ উঠেছে। বামেদের অভিযোগ, বাইকে চেপে এলাকায় সন্ত্রাস চালাতে গিয়েছিলেন তৃণমূল কর্মীরা। সেই সময়ই গন্ডগোল হয়। তৃণমূলের উল্টো দাবি, প্রচারে গিয়েছিলেন নরেশবাবুরা। সে সময় পরিকল্পিত হামলা চালায় বামেরা।
তৃণমূলের কোচবিহার জেলা সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষ অবশ্য বলেন, “বাইক বাহিনীর বিষয়টি জানা নেই। দিনহাটাতে প্রচারের সময় দু’দিক থেকে ঘিরে হামলা করে আমাদের কর্মীকে খুন করা হয়।”
রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা ফরওয়ার্ড ব্লকের জেলার নেতা পরেশ অধিকারী বলেন, “তৃণমূলের বাইক বাহিনী গোটা জেলায় সন্ত্রাস তৈরির চেষ্টা করছে। প্রচারে যাতে কেউ না বার হন, সেই ভয় দেখানো হচ্ছে। কিন্তু ওঁরা খুব সুবিধে করতে পারছে না।” জেলার মেখলিগঞ্জে অবশ্য বামেদের বিরুদ্ধেই ‘বাইক বাহিনী’ নামিয়ে সন্ত্রাসের অভিযোগ উঠেছে। পরেশবাবু যথারীতি অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন।
অভিযোগ পৌঁছেছে কোচবিহারের জেলাশাসক মোহন গাঁধীর কাছেও। তিনি বলেন, “এই রকম কিছু অভিযোগ পাচ্ছি। পুলিশকে বিষয়গুলি দেখতে বলা হয়েছে।” আর জেলা পুলিশ সুপার অনুপ জয়শওয়াল বলেন, “প্রতিটি থানায় নজরদারি বাড়ানোর জন্য বাড়তি ফোর্স দেওয়া হয়েছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এই ‘বাইক বাহিনী’ অবশ্য নতুন নয় কোচবিহারে। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে বামেদের বিরুদ্ধে ‘বাইক বাহিনী’ নামিয়ে তান্ডব চালানোর অভিযোগ ওঠে। এ বারেও একই অভিযোগ। কেবল অভিযোগের তির বেশিরভাগটাই তৃণমূলের দিকে। অভিযোগ, দলের যুবকদের সন্ধ্যায় বাইক মিছিলের কথা বলে ডেকে নেওয়া হচ্ছে পার্টি অফিসে। একবার গোটা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা চক্কর দেওয়ার জন্য কাউকে এক লিটার তেল বা দুই লিটার পেট্রোল ভরে দেওয়া হচ্ছে। কোনও সময় টাকাও গুঁজে দেওয়া হচ্ছে।
তুফানগঞ্জের ধলপল, নাককাটিগাছ থেকে দিনহাটার নয়ারহাট, চৌধুরীহাট, শুকারেরকুটি, সিতাই, মেখলিগঞ্জের কুচলিবাড়ি, চ্যাংরাবান্ধা সর্বত্রই বাইক বাহিনী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নয়ারহাটের এক সিপিএম কর্মী বলেন, “সন্ধ্যার পর তৃণমূলের ঝান্ডা লাগানো প্রচুর বাইক ঢুকে পড়ে গ্রামে। কেউ যাতে বামেদের ভোট না দেয় তাঁরা সে কথা বলে।” আবার কুচলিবাড়ির কয়েকজন তৃণমূল কর্মী বলেন, “বাইক বাহিনী নিয়ে সন্ধ্যার পর থেকেই গ্রামে ঘুরে বেড়ায় বাম কর্মীরা। মাইকে শাসানো হচ্ছে। তৃণমূল করলে ফল ভাল হবে না বলে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।” |