পঞ্চায়েত ভোট এখন হবে, না হবে না সে ধন্দ আজ হোক, কাল হোক কাটবে। কিন্তু মেয়াদ ফুরনোর পরে রাজ্যের প্রায় সাড়ে ৩ হাজার গ্রাম পঞ্চায়েতে উন্নয়ন-প্রক্রিয়ার কী হবে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটার লক্ষণ আপাতত দেখা যাচ্ছে না।
পঞ্চায়েতগুলির কার্যকাল শেষ হচ্ছে ৭ জুলাই। সব ঠিক চললে পঞ্চায়েত নির্বাচন শেষ হওয়ার কথা ১০ জুলাই। ফল ঘোষণা ১৪ জুলাই। কিন্তু প্রশাসনের হিসেবেই পরবর্তী বোর্ড গড়তে সময় লাগবে আরও এক মাস। পুরনো বোর্ডের বিদায় এবং নতুন বোর্ডের ক্ষমতায় আসার মাঝের সময়ে পঞ্চায়েত চালাবে কে, উন্নয়নের কাজই বা কী ভাবে করা যাবেস্পষ্ট বলতে পারছেন না মন্ত্রী-কর্তারা।
পরিস্থিতির জন্য পঞ্চায়েত নির্বাচনে দেরিকেই দায়ী করেছেন রাজ্য পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের কর্তাদের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, ১৯৭৮ সাল থেকে প্রতিবার পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছে পুরনো বোর্ডের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই। ফলে, পুরনোরা থাকতেই নতুন বোর্ড ক্ষমতায় এসেছে। নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে পঞ্চায়েত চালাতে সমস্যা হয়নি। এ বার হয়েছে ব্যতিক্রম। একই সমস্যা পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদ স্তরেও দেখা দেবে।
এমন পরিস্থিতি যেহেতু আগে তৈরি হয়নি, তাই গত বোর্ডের চলে যাওয়া এবং নতুন বোর্ডের ক্ষমতায় আসার মাঝের সময়ে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখে পঞ্চায়েত কী ভাবে পরিচালনা করা যাবে সে সংক্রান্ত আইনও নেই। সমস্যা যে হতে পারে সে কথা স্বীকার করে রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়নমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “দু’টো ব্যাপার আছে। মেয়াদ উত্তীর্ণ বোর্ড এবং নতুন বোর্ডের ক্ষমতায় আসার মধ্যে যে সময় থাকবে, তখন কী ভাবে পঞ্চায়েতগুলি পরিচালনা করা যায় সেটা দেখা এবং ওই সময়ে উন্নয়নের কাজও যাতে চলে তা নিশ্চিত করা। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। এখনও সিদ্ধান্তে আসা যায়নি।”
এমনিতেই নির্বাচনের বিজ্ঞপ্তি জারি হওয়ার পর থেকে উন্নয়নমূলক নতুন প্রকল্পে কাজ প্রায় বন্ধ। রাজ্যের সেরা ১,০০০ গ্রাম পঞ্চায়েতে বিশ্ব ব্যাঙ্কের সশক্তিকরণ প্রকল্পে মে মাসে যে অনুদান আসার কথা ছিল, ভোটের ঢাকে কাঠি পড়ায় তা স্থগিত করা হয়েছে। অথচ, এই টাকা খরচ করতে হবে সেপ্টেম্বরের মধ্যে। জুলাই থেকে অগস্ট পর্যন্ত যদি গ্রাম পঞ্চায়েতগুলি অচল থাকলে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে টাকা খরচ করে তার হিসেব দেওয়া কঠিন হবে। আবার হিসেব না দিলে পরবর্তী বরাদ্দ আসবে না। ত্রয়োদশ অর্থ কমিশন, তৃতীয় রাজ্য অর্থ কমিশন প্রভৃতি তহবিলের টাকাও খরচ করা যাবে না। কারণ, ওই টাকা খরচ করতে হলে পঞ্চায়েতের বৈঠকে প্রস্তাব অনুমোদিত হওয়া দরকার। ১০০ দিনের প্রকল্পের মজুরিও আটকে যাবে মাঝের ওই সময়ে।
অতঃকিম? দু’টি সম্ভাবনার কথা শোনা যাচ্ছে প্রশাসনের অন্দরে। প্রথমত, অন্তর্বর্তী সময়ে বিদায়ী বোর্ডকেই তদারকির দায়িত্ব দেওয়া। যেমন লোকসভা বা বিধানসভার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের রেওয়াজ আছে। তবে ওই অন্তর্বর্তী বোর্ড বেতন দেওয়া, চেকে সই করার মতো কাজ করতে পারবে না। কারণ, সেই আর্থিক ক্ষমতা তাদের থাকবে না। পঞ্চায়েত দফতরের কর্তারা অবশ্য এই সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তাঁদের মতে, প্রচলিত আইন অনুযায়ী এ ধরনের অন্তর্বর্তী তদারককারী বোর্ডের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। কারণ, মেয়াদ ফুরোলে বিদায়ী বোর্ডের সদস্যেরা এক মূহূর্ত পঞ্চায়েতের কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবেন না।
দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি হল, প্রশাসনিক আধিকারিক নিয়োগ করে পঞ্চায়েতের কাজ চালানো। রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের প্রাক্তন সচিব মানবেন্দ্রনাথ রায় যেমন মনে করেন, “পঞ্চায়েত নির্বাচন না হলেও দার্জিলিঙে প্রশাসনিক আধিকারিক নিয়োগ করে পঞ্চায়েতের বরাদ্দ অর্থ খরচ হচ্ছে। অন্ধ্রপ্রদেশে বছরের পর বছর নির্বাচন হয় না। প্রশাসনিক আধিকারিক নিয়োগ করে সেখানেও পঞ্চায়েতের বরাদ্দ খরচ হচ্ছে।” এ ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত সমস্যা আছে। মেয়াদ ফুরনো পঞ্চায়েতে সরকারি প্রশাসক নিয়োগ করতে হলে যে আইন দরকার, তা এ রাজ্যে নেই। সে জন্য নতুন আইন করতে হবে।
তা ছাড়া, প্রশাসনিক কর্তাদের একট বড় অংশের প্রশ্ন রয়েছে এই পদ্ধতি নিয়ে। তাঁদের বক্তব্য, এই ব্যবস্থায় গ্রাম পঞ্চায়েতের দৈনন্দিন কাজকর্ম পরিচালনা করা গেলেও উন্নয়ন কি সম্ভব?
সদস্যেরা অনিয়মিত হয়ে পড়ায় রাজ্যে যে সব পঞ্চায়েত অচল হয়েছিল, সেখানে কাজ চালু করার দাওয়াই ক্ষমতায় আসার পরই দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। জেলায় জেলায় গিয়ে ওই ধরনের পঞ্চায়েতগুলিতে বিডিও-দের সরাসরি কাজ করতে বলেছিলেন। সেই প্রচেষ্টা কিন্তু খুব একটা সফল হয়নি। কারণ, উন্নয়ন সংক্রান্ত কোনও কাজ করতে গেলে তা পঞ্চায়েতের নির্বাচিত সদস্যদের বৈঠকে অনুমোদিত হতে হয়। এই আইনের বেড়াজালে পড়ে বিডিও-রা অচল গ্রাম পঞ্চায়েতগুলিতে কার্যত কিছুই করতে পারেননি। প্রশাসনের একটি সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রীর ওই নির্দেশের আগে গোটা রাজ্যে ৬৫টি গ্রাম পঞ্চায়েত অচল ছিল। এখন সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০০-য়।
পঞ্চায়েতমন্ত্রী বলেন, “এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে পদ্ধতিগত অনেক দিক খতিয়ে দেখতে হবে। একাধিক বিকল্প নিয়ে আলোচনা করছি।” রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র সমস্যাটি প্রশাসনিক সঙ্কটের বদলে রাজনৈতিক দৃষ্টিতে দেখছেন। তাঁর মন্তব্য, “প্রথম থেকেই বলছি, আমলা এবং দলীয় উপদেষ্টা কমিটি গড়ে পঞ্চায়েতগুলি চালাতে চাইছে তৃণমূল। এটা তারই প্রথম পদক্ষেপ। সেই কারণেই এই সরকার পঞ্চায়েত নির্বাচন করাতে চাইছে না।”
|