কলকাতা পারেনি, আগরতলা পেরেছে। সবুজ প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও তার প্রয়োগকৌশলে পশ্চিমবঙ্গকে ছাড়িয়ে গিয়েছে ত্রিপুরা। পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ তৈরির উদ্দেশ্যে দেশে প্রথম অপ্রচলিত শক্তি উন্নয়ন নিগম তৈরি হয় পশ্চিমবঙ্গেই। কিন্তু দেরিতে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয়ে ত্রিপুরা ‘সবুজ প্রযুক্তি’ রূপায়ণে অনেক এগিয়ে গিয়েছে। ইন্দিরা আবাস যোজনায় কেন্দ্র দারিদ্র সীমার নীচে থাকা মানুষদের বাড়ি প্রতি ৫০ হাজার টাকা দেয়। পশ্চিমবঙ্গে দেখেছি, ঝড়-বৃষ্টি সহ্য করার মতো শক্তি ওই বাড়িগুলির থাকে না। কেন্দ্রের টাকার সঙ্গে ১০ হাজার টাকা যোগ করে ত্রিপুরায় তৈরি হচ্ছে সবুজ প্রযুক্তির বাড়ি।
কম সিমেন্ট, কম লোহা দিয়ে তৈরি হচ্ছে ফেরোসিমেন্ট টাইলস। এই টাইলস দুটি পাশাপাশি বসিয়ে তৈরি করা যায় এমন একটি দেওয়াল, যার ভিতরটা ফাঁপা। গরম কালে বাইরের গরম ঘরে ঢোকে না, শীতের সময় ঘরের গরম বেরোয় না বাইরে। এ এক এক ধরনের ‘সবুজ’ প্রযুক্তি। ইটের বদলে ওই ফেরোসিমেন্ট টাইলস দিয়ে তৈরি হচ্ছে বাড়ি, রেস্তোরাঁ, স্কুল। ফেরোসিমেন্ট টাইলস তৈরি করছে একটি বেসরকারি সংস্থা, নাম অর্কনীড়। পশ্চিমবঙ্গের অপ্রচলিত শক্তি উন্নয়ন নিগমের প্রথম সভাপতি শান্তিপদ গণচৌধুরীর উদ্যোগে তৈরি হয় সংস্থাটি। আগরতলা থেকে বেশ কিছুটা দূরে ফেরোসিমেন্ট টাইলস কারখানায় দেখা হল তাঁর সঙ্গে। বিশাল জমিতে সার দিয়ে তৈরি হচ্ছে ওই টাইলস। কারখানার ভিতরেই তৈরি হয়েছে হোটেল ম্যানেজমেন্ট কলেজ। তিনতলা ওই বাড়ির দেওয়াল ফেরোসিমেন্ট টাইলসের তৈরি। কারখানার দেওয়াল তৈরি হয়েছে ওই একই প্রযুক্তিতে। কারখানার ঠিক গেটের সামনেই একটি একতলা গোলাকার বাড়ি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। কারখানার এক কর্তা বলেন, “এটা আমরা পরীক্ষামূলক ভাবে তিন বছর আগে তৈরি করেছিলাম। রোদ, ঝড়, জল খেয়েছে বাড়িটি। কিন্তু এতটুকুও টলেনি।”
প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত এক ইঞ্জিনিয়ার বললেন, “সুন্দরবনে অনেক জায়গায় গিয়ে দেখেছি, ইন্দিরা আবাস যোজনায় (বর্তমানে এটাই নিজ ভূমে নিজ বাড়ি প্রকল্প) মাটি দিয়ে তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে বাড়ি। সেই বাড়ি এক মরসুমের ঝড়বৃষ্টিই সহ্য করতে পারছে না। বর্ষার পরে ফের নতুন করে তৈরি করতে হচ্ছে বাড়ি। একই বাড়ির জন্য বার বার টাকা খরচ হচ্ছে। করদাতাদের টাকার অপব্যবহার হচ্ছে।”
এই টাইলস পরিবেশবান্ধব হল কেমন করে? শান্তিপদবাবু বলেন, “প্রথমত ইট না লাগায় ইট তৈরির সময়ে যে পরিবেশ দূষণ হয় তা এড়ানো যাচ্ছে। মোটা ইস্পাতের রড তৈরি করতে পরিবেশে বেশি কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গত হয়। এখানে সরু ইস্পাতের শলাকা ব্যবহার করায় প্রকৃতিতে কার্বন ডাইঅক্সাইডের নির্গমণ পরোক্ষ ভাবে কমে যাচ্ছে। দেওয়ালে ফাঁক থাকায় বাড়ি বেশি গরম হচ্ছে না গ্রীষ্মে। ফলে পাখা ব্যবহারের সময় কমে যাচ্ছে। বিদ্যুতের সাশ্রয় হচ্ছে। টাইলসের দেওয়ালে প্লাস্টার করার প্রয়োজন পড়ছে না। ফলে বেঁচে যাচ্ছে সিমেন্ট। সিমেন্ট তৈরির সময় যে পরিবেশ দূষণ হয়, সেটা রোধ করা যাচ্ছে।
কিন্তু যেখানে ইট ছাড়া চলবে না সেখানে কী হবে? সেই ব্যবস্থাও রয়েছে। অর্কনীড়ের অন্য একটি কারখানায় মাটির সঙ্গে অল্প সিমেন্ট মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে কম খরচের ইট। বাজারে যে ইট বিক্রি হয়, দাম তার অর্ধেক। এ ছাড়া, বাড়ির দরজা জানালায় ব্যবহৃত হচ্ছে বাঁশ ও বেত। ছাদে বসানো হচ্ছে সৌর গরম জলের যন্ত্র। ঘরের মধ্যে থাকছে এলইডি লাইট। ত্রিপুরায় দু’হাজার পরিবেশবান্ধব বাড়ি তৈরি হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে সৌরশক্তি এবং অন্য অপ্রচলিত শক্তি আন্দোলন গড়ে উঠেছে শান্তিপদবাবুর হাত ধরেই। তাঁর আক্ষেপ, “পশ্চিমবঙ্গের উপকূলবর্তী এলাকাতে এই প্রকল্প সফল ভাবে রূপায়ণ করা যেত। সেটা হল না। আমাদের প্রচারে হয়তো কোনও ঘাটতি ছিল। আমার আশা, ত্রিপুরাকে দেখে এক দিন পশ্চিমবঙ্গও শিখবে এই প্রযুক্তি। রাজ্য জুড়ে তৈরি হবে পরিবেশবান্ধব বাড়ি।” |