উইনস্টন চার্চিল তাঁর আত্মকথায় জানিয়েছিলেন, রাজনৈতিক সঙ্কটে যখনই তাঁর উদ্বেগের পারদ ঊর্ধ্বমুখী হত, ঠিক তখনই তিনি বাথটবে উষ্ণ জলে শুয়ে শুয়ে চুরুট খেতেন। সে চুরুটের গন্ধে দশ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট ম-ম করত। আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাঁর লাগাতার উৎকণ্ঠায় কী করছেন সে কথা তিনি এখনও কাউকে জানাননি।
এক দিকে শাসক কংগ্রেস ও তার জোট ইউ পি এ বিবিধ আর্থিক ও রাজনৈতিক বিড়ম্বনার শিকার। আর্থিক বৃদ্ধির হার নিম্নগামী। দেশের অধিকাংশ নীতি পক্ষাঘাতদুষ্ট। মূল্যস্ফীতির অঙ্ক এখনও স্বস্তি দিতে অপারগ। টাকার দাম কমেই চলেছে। অথচ রাজধানীতে বসে রাজনীতিকরা এই প্রতিকূল পরিস্থিতি বুঝেও যেন বুঝতে পারছেন না। বড় বিস্ময় লাগে।
এমনটাই অবশ্য রাজনেতাদের বৈশিষ্ট্য। অটলবিহারী বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী আর লালকৃষ্ণ আডবাণী উপপ্রধানমন্ত্রী, সেই এন ডি এ জমানার শেষ লগ্নে দুই প্রবীণ নেতাকেই বলতাম, আপনারা ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’-এর ঢক্কানিনাদে ব্যস্ত, কিন্তু বাস্তব তো মনে হচ্ছে আলাদা। অন্ধ্রপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে কৃষকদের আত্মহত্যার খবর আসছে। এই পরিস্থিতিকে কি ‘ফিল গুড’ বলা যায়? তখন কিন্তু দু’জনেই মনে করছিলেন, পরিস্থিতি তাঁদের পক্ষে অনুকূল, আর যা-ই হোক মানুষ কংগ্রেসকে কিছুতেই গ্রহণ করতে পারে না। আডবাণী তো এক ধাপ এগিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা ম্যানেজ করে নেব।’ এতটাই অতি-আস্থা ছিল বিজেপির যে তাঁরা ভোটটা কয়েক মাস এগিয়ে এনেছিলেন। আডবাণী অবশ্য পরাজয়ের পরে স্বীকার করেন যে তখন বাজপেয়ী আগাম ভোট না চাইলেও তিনিই দলকে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করেন। |
নন্দীগ্রামের পরেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ভাবতে পারেননি মানুষ সি পি এমকে এ ভাবে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করবে। তৃণমূলের ক্রমবর্ধমান আধিপত্যের কথা বলতে গেলে তিনি বলেছিলেন, ‘মানুষ সব বোঝে, ও আমরা সামলে নেব।’ আজ ইতিহাসের এক অদ্ভুত পুনরাবৃত্তি দেখছি। দিল্লিতে ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে বসে শীর্ষ কংগ্রেস নেতারাও ভাবছেন, এটাই বোধহয় ভারত, এখনও তাঁরাই বলে দেবেন, দেশের মানুষ ‘ফিল গুড’ করছেন কি না। অথচ বিভিন্ন রাজ্য সফরে গিয়ে যখন আমজনতার সঙ্গে কথা বলছি, তখন দেখছি, দিল্লির মসনদের বিরুদ্ধে মানুষের বিদ্রোহ টগবগ করে ফুটছে।
আর বিজেপি? সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে চেয়েছে। রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতা অথবা বিকেন্দ্রীকরণ, সংস্কারের সঙ্গে সামাজিক দায়বদ্ধতা, দক্ষিণপন্থার সঙ্গে বামপন্থা, এনডিএ-জোট জমানায় বিজেপিও কম আপস করেনি। কিন্তু এখন তার সামনে অন্য সমস্যা। বিজেপি স্পষ্ট করে দিয়েছে, ২০১৪ সালে তাদের প্রধান ‘মুখ’ নরেন্দ্র মোদীই। তাঁকে সামনে রেখেই বিজেপি এগোতে বাধ্য, কারণ দলের কর্মীদের কাছে এই মুহূর্তে তিনিই সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। কিন্তু নীতীশ কুমারের পক্ষে মুখ বুজে তা মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। প্রশ্ন উঠতে পারে, বিজেপিকে ছাড়লে কি নীতীশের রাজনৈতিক লাভ? এ প্রশ্নের জবাব একটাই। রাজনীতিতে এক জন নেতা বা একটি দল অনেক সময় এমন অনেক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় যাতে তাদের রাজনৈতিক লাভ নেই, কিন্তু নিজেদের ভোটার, বা বলা যায়, রাজনৈতিক উপভোক্তাদের কাছে নিজেদের ভাবমূর্তিকে ঠিক রাখার জন্যও অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এ এক ধরনের নৈতিক চাপ।
এ বার মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি যদি এক নতুন যুগ শুরু করে তবে গোটা দেশে তার রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা-ও তো দেখার। বিজেপি এক রূপান্তর পর্বের মধ্যে দিয়ে চলেছে। মোদী আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রধান মুখ হলে ফের এ দেশে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মেরুকরণ হবে কি না সেটাও দেখার। যদিও মোদী বার বার নিজেকে গুজরাতে হ্যাটট্রিক করা দক্ষ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন, ভুল করেও রামমন্দির নির্মাণের কথা বলছেন না, কপালে তিলক লাগিয়ে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান তুলছেন না। কিন্তু তবু আশঙ্কা আছে, ভোট প্রচারের সময় এক দিকে কংগ্রেস সংখ্যালঘু ভোট পাওয়ার জন্য এই মেরুকরণকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার কাজে লাগাবে, আবার অন্য দিকে সঙ্ঘ পরিবার ‘মোদীত্ব’কে মূলধন করে হিন্দু-জাতীয়তাবাদের প্রচারে আগ্রাসী হবে।
২০০৪ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ী ছিলেন বিজেপির প্রধান ‘মুখ’। সে দিন আডবাণী ছিলেন কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী। ২০০৯ সালে এসে আচমকা দেখলাম, আডবাণীর বাজপেয়ীকরণ হয়ে গিয়েছে। তিনি সে দিন ধর্মনিরপেক্ষ উদার আডবাণী আর মোদী কট্টরবাদী। পাকিস্তান সফরে জিন্না-বিতর্কের পর আডবাণী হয়ে গেলেন উদার আর গোধরা-কাণ্ডের পর মোদী হলেন উগ্র হিন্দুয়ানার মুখ। বিজেপিতে এই দু’টি মুখের রাজনীতির বয়স দীর্ঘ। গোবিন্দাচার্য তো বলেই বসেছিলেন, আডবাণী মুখ আর বাজপেয়ী মুখোশ। নরেন্দ্র মোদী কি এখন টু-ইন-ওয়ান হতে চাইছেন: তিনিই বাজপেয়ী এবং তিনিই অতীতের আডবাণী? এই দ্বৈতবাদ কি সম্ভব?
অন্য দিকে, কংগ্রেস শিবিরে মনমোহন সিংহর নেতৃত্বের বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে এসে ঠেকেছে, পাশাপাশি আজও আমজনতা রাহুল গাঁধীকে প্রধান বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করতে দ্বিধাগ্রস্ত। নেতার মুখ নিয়ে তাই কংগ্রেসে আজ বিজেপির চেয়েও সংশয় বেশি। কংগ্রেস যে আবার সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে গোটা দেশের বহুত্ববাদী সংস্কৃতির প্রধান ধারক ও বাহক দল হবে তা-ই বা হচ্ছে কোথায়? রাহুল গাঁধী ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতাকে স্মরণ করিয়ে প্যান-ইন্ডিয়ানিজমের কথা বলছেন। একটা সময় ছিল যখন কংগ্রেস সব ধর্ম, সব জাতি, সব আঞ্চলিক প্রত্যাশার প্রতিনিধিত্ব করেছে, কিন্তু ক্রমশ দেখা গেল কংগ্রেসের শীর্ষনেতৃত্ব অভিজাততন্ত্রের শিকার, আমজনতা থেকে বিচ্ছিন্ন। কংগ্রেস ক্রমিক অবক্ষয়ের শিকার হল। ইন্দিরা জমানায় হাইকমান্ডই হয়ে উঠল এক সর্বশক্তিধর বিষয়। আঞ্চলিক নেতারা দুর্বল থেকে দুর্বলতর হলেন। রাজ্য সংগঠনগুলি মুখ থুবড়ে পড়ল। সাতচল্লিশের পর থেকে ভারতের আপাত-অখণ্ডতার অন্তরালে বিচ্ছিন্নতার স্রোত যেন ছিল অন্তঃসলিলা। কাশ্মীর থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চল, উত্তরপ্রদেশ থেকে তামিলনাড়ু এই বিপুল এবং বিচিত্র দেশের আন্তঃরাজ্য সম্পর্কের মধ্যেও বার বার ধরা পড়েছে অনেক বিভাজিকা রেখা।
আজ ক্ষমতায় আসতে চাইছে সকলেই। অথচ অবক্ষয় সব দলে। এই রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে যদি মূল্যবৃদ্ধি আর দুর্নীতিকে কার্পেটের নীচে লুকিয়ে দুই প্রধান পক্ষই আবার মেরুকরণের রাজনীতির অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণের সস্তা পথে হাঁটতে চায়, তবে তার পরিণতিই বা কী হবে? সে-ও এক গভীর শঙ্কা এবং অনিশ্চয়তা। আবার দাঙ্গা? না কি মানুষ মেরুকরণকে বর্জন করে এ বার উন্নয়নের, সুশাসনের ডাক দিতে চাইবে?
এই পরিস্থিতিতে কিছু আঞ্চলিক নেতা আবার তৃতীয় ফ্রন্ট বা চতুর্থ ফ্রন্ট গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন। সে-ও এক মস্ত বড় ধাঁধা। রাজ্যগুলির রাজনৈতিক মেরুকরণ প্রবল। বাম নেতারা তৃতীয় ফ্রন্ট করতে চাইলে তাতে তৃণমূল কংগ্রেস থাকতে পারে না। অ-কংগ্রেসি, অ-বিজেপি ফ্রন্টে একই সঙ্গে জয়ললিতা ও করুণানিধি শামিল হন কী করে? মুলায়ম এবং মায়াবতী একই ফ্রন্টে? এ-ও এক গভীর অনিশ্চয়তা। আসলে এ দেশে আঞ্চলিক দলের নেতৃত্ব তৃতীয় ফ্রন্ট গঠন করলে অতীতে তা সর্বদাই হয় কংগ্রেস অথবা বিজেপি এই দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন নিয়েই সম্ভব হয়েছে। এ বার কি অন্য ইতিহাস তৈরি হবে? আপাতত, হাতে রইল প্রশ্নটাই। |