ভাওয়াইয়ার সুরে সারদা-ত্রিফলা |
অনির্বাণ রায় • জলপাইগুড়ি |
বর্ষার উথালপাথাল তিস্তা। মণ্ডলঘাটের নদী ঘাটে বাঁশ-পলিথিনের ছোট্ট একটা ছাউনি। ভেসে আসছে প্রচলিত ভাওয়াইয়ার সুর। কিন্তু কথাগুলো তো চেনা নয়।
“কাঁদাইলেন মা মাটি মানষিগুলাকে
তোমার কোম্পানিৎ টাকা রাখিবারে কইলেন
ভরসা দিয়ে ভাসাইলেন গহীন গাঙে।”
ভাওয়াইয়া গানে ‘মা-মাটি-মানুষ’ ‘কোম্পানি’!
সারদা কাণ্ডের জের!
একই রকম অচেনা লাগল বেরুবাড়ির হাটের মধ্যে শোনা প্রভাতি বন্দনার সুরের কথাও।
“ভজ গৌরাঙ্গ, জয় গৌরাঙ্গ হে
লাগিয়ে পথে পথে গৌরাঙ্গ বাতি
গুছিয়ে নাও তোমার কাম হে।”
‘গৌরাঙ্গ বাতি’!
পরিবর্তনের জামানার ত্রিফলা আলোই তো!
প্রচলিত সুরে, কথা বসিয়ে ডান-বাম রাজনৈতিক দলের ভোট প্রচার উত্তরবঙ্গে কোনও নতুন ঘটনা নয়। সেই হাওয়ায় এবার ‘সারদা কাণ্ড’, ‘ত্রিফলার’ জেরও। গান লিখেছেন জলপাইগুড়ির কংগ্রেস বিধায়ক সুখবিলাস বর্মা। প্রাক্তন এই সরকারি আমলা ভাওয়াইয়া শিল্পীও বটে। নিজস্ব গানের দল রয়েছে। নিজের বিধানসভা ভোটের প্রচার মঞ্চেও তিনি গান গেয়েছেন। বিধায়ক হওয়ার পরেও গ্রামে, সরকারি, ও বেসরকারি অনুষ্ঠানে ডাক পড়লে গানের দল নিয়ে হাজির হয়ে যান। পঞ্চায়েত ভোটেও প্রদেশ তথা জেলা কংগ্রেসের প্রচার কমিটিতে রয়েছেন। যথারীতি বেছে নিয়েছেন তাঁর নিজস্ব প্রচারশৈলি। লোকগান নিয়ে বইও লিখেছেন সুখবিলাস। ‘ইন্ডিয়ান ফোক মিউজিক ভাওয়াওয়া: এথনোমিউজিক্যাল স্টাডি’ এবং ‘সোশিও পলিটিক্যাল মুভমেন্টস ইন নর্থ বেঙ্গল।’ |
নিজের গানের সিডি নিয়ে সুখবিলাস। ছবি: সন্দীপ পাল। |
১৪টি গান লিখে, প্রচলিত সুরে রেকর্ড করে ৫ হাজার সিডি তৈরি করেছেন তিনি। দোতারা, বাঁশি, ঢোল, সারেঙ্গার সঙ্গতে গান গেয়েছেন বিধায়ক নিজেই। সঙ্গে রয়েছেন ছ’জন বাদ্য শিল্পী। খরচ প্রায় এক লক্ষ টাকা। বিধায়কের কথায়, “দলের কোনও নেতা যদি প্রচারের জন্য সিডি কেনেন তবে কিনবেন। না হলে নিজেই দলের নেতা কর্মীদের ডেকে সিডি বিলি করব।” সরকারি অনুষ্ঠানের মঞ্চে বিধায়ক হিসেবে উপস্থিত থাকা সুখবিলাসবাবুর বক্তৃতার ডাক পড়ার পরেই সুখবিলাসের গলায় একটা গান অনিবার্য। তিনি বলেন, “গানেই আমি বেশি স্বচ্ছন্দ। বক্তৃতার থেকে গান মানুষকে বেশি প্রভাবিত করে। আর সে গান যদি ভাওয়াইয়া হয়, তাহলে তো আর কথাই নেই, গ্রামে পুরো হিট।”
প্রচারের-নানা গানে প্রচলিত গাঁথার সঙ্গে মিশেছে সাম্প্রতিক নানা রাজনৈতিক ঘটনা। একটি গানের কথায়, চণ্ডীদাসও রয়েছেন।
“চণ্ডীদাস আর রজকিণী
এক মরণে দুই জন মরে,
এমন মরে কয় জনা!
আর তৃণমূল চিটফান্ডের প্রেমে
মরল রে অনেক জনা।”
এই প্রেমের মরণ যে সারদাকাণ্ডের জেরে উঠে আসা একের পর এক মৃত্যুর অভিযোগ, তা বুঝতে ভুল হচ্ছে না, গ্রামের বাসিন্দাদের।
গত সোমবার বিধায়কের সিডি হাতে পেয়ে আপ্লুত প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক বিশ্বরঞ্জন সরকার। তিনি বলেন, “সুখবিলাসবাবুর গাওয়া এই গানগুলি এক কথায় অসাধারণ। আমরা এই সিডিগুলি প্রতিটি গ্রামে গ্রামে বাজাব।”
গানের কয়েকটি কলি শুনে অবশ্য প্রশ্ন তুলেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের জলপাইগুড়ি সাংগঠনিক জেলা সভাপতি চন্দন ভৌমিক। তাঁর প্রশ্ন, “ভোট হবে গ্রাম এলাকায়। সেখানে ত্রিফলা আলো কোথায়? নদী ভাঙন, পাকা রাস্তা, ঘরে বিদ্যুৎ এই দাবিতেই মানুষ ভোট লড়েন। ওঁর (বিধায়কের) তো জনসংযোগ নেই, তাই বিষয় গুলিয়ে ফেলেছেন।”
কিন্তু সারদা কাণ্ড? সে তো গ্রামেও রয়েছে। চন্দনবাবু বলেন, “কোনও গঠনমূলক কথা না বলে শুধু তৃণমূলকে গালি দেওয়া কংগ্রেসের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে।” |