শ্রমিক সংগঠনের দখলদারি নিয়ে শাসক দল তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর বিরোধ গড়িয়েছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিল্পনগরী হলদিয়া পর্যন্ত। সেই তালিকায় নবতম সংযোজন বাংলার চটশিল্প।
শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় না দোলা সেন তৃণমূলের এই দুই শ্রমিক-নেতানেত্রীর অধীন কোন গোষ্ঠী চটশিল্পের ত্রিপাক্ষিক চুক্তিতে সই করবে, তা নিয়ে বিরোধের জেরে কেন্দ্রীয় সরকারের বরাত হাতছাড়া হতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গের! এই নিয়ে অবশ্য কোনও পক্ষেরই ভ্রুক্ষেপ নেই। শাসক দলের নেতাদের এমন প্রকাশ্য কোঁদল দেখে বাম শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের হুঁশিয়ারি, এই ভাবে চললে তাঁরা চটশিল্পে ধর্মঘট ডাকবেন।
১২ জুন দিল্লিতে বস্ত্র মন্ত্রকের স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও পশ্চিমবঙ্গের চটশিল্পের হালহকিকত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। ওই বৈঠকে ঠিক হয়েছে, চলতি বছরে গোটা দেশে খাদ্যশস্য ভরার জন্য যে ৩৩ লক্ষ গাঁট বস্তার প্রয়োজন, তার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সরবরাহের বরাত কৃত্রিম তন্তুর ব্যাগ তৈরির সংস্থাকে দেওয়ার কথা ভাবতে হবে। কারণ, বর্তমান অচলাবস্থায় পশ্চিমবঙ্গের চটকলগুলি পুরো চাহিদা মেটাতে পারবে না বলেই মনে করছে স্থায়ী কমিটি।
কী ভাবে চটের বস্তার বরাত হারাতে পারে পশ্চিমবঙ্গ?
বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতারা জানান, চটশিল্পে দু’বছর অন্তর ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হয়। অভিযোগ, গত মার্চে নতুন চুক্তি সইয়ের কথা থাকলেও তৃণমূলের শ্রমিক-নেতাদের বিরোধের জন্য তা হতে পারেনি। এবং এখনও হয়নি সেই চুক্তি। এর ফলে গোটা চটশিল্পেই উৎপাদন মার খাচ্ছে। তৈরি হচ্ছে নানান সমস্যা। চটকল-মালিকদের বক্তব্য, আর্থিক বছরের প্রায় তিন মাস কেটে গিয়েছে। চুক্তি না-হলে পূর্ণ মাত্রায় কাজ করা যাচ্ছে না। তার উপরে ধর্মঘটের হুঁশিয়ারিও রয়েছে। এই কারণে পশ্চিমবঙ্গ গোটা দেশের চাহিদা পূরণ করতে পারবে না বলে মনে করছে স্থায়ী কমিটি।
তৃণমূলে কিন্তু গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব থামার লক্ষণ নেই। ২৪ মে রাজ্যের শ্রম কমিশনার জাভেদ আখতারের ডাকা শেষ ত্রিপাক্ষিক বৈঠক ভেস্তে যায় ওই গোষ্ঠী-কোঁদলের জন্যই। সেই বৈঠকে আইএনটিটিইউসি-র রাজ্য সভাপতি হিসেবে দোলাদেবী উপস্থিত হন। কিন্তু শোভনদেব গোষ্ঠীর তরফে ন্যাশনাল জুট ফেডারেশনের প্রায় ১৫০ সমর্থকও হাজির হন বৈঠকে। সেখানে আলোচনার বদলে দু’পক্ষের মধ্যে স্লোগান, কটূক্তি, হাতাহাতি চলতে থাকে। অন্য শ্রমিক সংগঠনের নেতারা ছিলেন দর্শক। শেষ পর্যন্ত দু’পক্ষকে থামাতে পুলিশ ডাকতে হয়!
এই অবস্থায় ১১ জুন চটকল-মালিকদের সংগঠন আইজেএমএ-র সঙ্গে বৈঠক করেন শ্রম কমিশনার। পরের ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে শাসক দলের কোন গোষ্ঠীকে ডাকা হবে, তা নিয়ে ধন্দ কাটাতে পারেননি তাঁরা। খানিকটা অসহায় হয়েই শ্রম কমিশনার বলেন, “যে-গোষ্ঠীর নাম আমাদের কাছে নথিভুক্ত আছে, তাদেরই ডাকা হবে। আর কী বলব!”
কী বলছেন তৃণমূলের বিবদমান দুই গোষ্ঠীর নেতানেত্রীরা?
শোভনবাবুর অভিযোগ, “চটশিল্পে দোলার নিজের তৈরি ইউনিয়নের সংখ্যা হাতে গোনা। তা-ও তিনি নকশাল থাকার সময় সে-সব তৈরি হয়েছিল। আইএনটিটিইউসি-র যত ইউনিয়ন, সবই আমার সংগঠনের বর্তমান সর্বভারতীয় সভাপতি সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৈরি।” দোলাদেবী অবশ্য দলীয় শৃঙ্খলার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, “শোভনদার সঙ্গে আমার বিরোধ নিয়ে জানতে চাইলে কিছুই বলব না। তবে শ্রমিক-মালিক-সরকারের মধ্যে ত্রিপাক্ষিক চুক্তির জন্য ইতিমধ্যেই তিন-চারটি বৈঠক হয়েছে। আশা করছি, শ্রমমন্ত্রী ও শিল্পমন্ত্রীর উপস্থিতিতে খুব শীঘ্রই চুক্তিও হয়ে যাবে। কোনও সমস্যা হবে না।”
শোভনবাবুর বক্তব্য, একটাও বৈঠক হয়নি। তিনি বলেন, “সংগঠনের সর্বভারতীয় সভাপতি সুব্রতদা আমার ফেডারেশনকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। আমাদের ফেডারেশনকে স্বীকৃতি দিয়েছে চটকল-মালিকদের সংগঠন আইজেএমএ-ও। ওই ফেডারেশনের অধীনে ৫২টি চটকলে ইউনিয়ন আছে। সব ক’টাই আমার তৈরি। দোলা কোনটা তৈরি করেছে? ও কোন অধিকারে শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব করবে? শ্রম দফতর বৈঠক ডাকলে আমাদেরই ডাকতে হবে।”
সিপিআইয়ের শ্রমিক সংগঠন এআইটিইউসি-র দেবাশিস দত্ত জানান, ত্রিপাক্ষিক বৈঠক ডাকা হয়েছে এক বারই এবং ওদের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের জন্য সেখানে কোনও আলোচনাই হয়নি। আইএনটিইউসি-র নেতা গণেশ সরকার বলেন, “২৪ মে-র বৈঠকে হাতাহাতি হয়েছে।” দলের দুই গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বকে অবশ্য প্রকাশ্যে আমলই দিতে রাজি নন সুব্রতবাবু। এই নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ উত্তর, “আমরা তো তৈরি। শ্রম দফতরই বৈঠক ডাকতে পারেনি। আমরা কী করব?” |