দিনে চারটে ম্যাচও খেলেন পেশাদার ‘খেপ’ ফুটবলার
ফাইনাল ম্যাচের পর শেষ বিকেলের আলোয় হুগলির পান্ডুয়া ফুটবল মাঠে তখন পুরস্কার দেওয়ার পালা চলছে। কিন্তু খোঁজ নেই ম্যাচের সেরা ফুটবলারের। বিপক্ষকে ঘাস ধরিয়ে সেই ফুটবলার তখন পান্ডুয়া স্টেশনে বর্ধমানগামী ট্রেনের অপেক্ষায়। সন্ধ্যা সাতটায় মেমারিতে পরের খেলাটায় পৌঁছতেই হবে তাঁকে। আগাম টাকা নেওয়া আছে।
ফুটবলারটির নাম সুজয় দেবনাথ। বাড়ি পান্ডুয়াতে। দাপিয়ে খেলেছেন কলকাতার কালীঘাট, মহামেডান এসি, পিয়ারলেসের মত দলে। পিয়ারলেসে খেলার সময় চোট পাওয়ার পর এক বছর মাঠে নামতে পারেননি। শেষ হয়ে যায় বড় দলে খেলার স্বপ্ন। সংসার চালানোর জন্য শুরু করেন বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে ভাড়া খেলা। গ্রামীণ ভাষায় যার নাম ‘খেপ খেলা’। এখন কলকাতার একটি দ্বিতীয় ডিভিশনের দলে খেলার সঙ্গে সঙ্গে বর্ধমান শহর, আসানসোল, মেমারি, হুগলির ডানকুনি-সহ নানা জায়গার ফুটবল ক্লাবে ভাড়া খেলেন তিনি। যখন খেলা থাকে না তখন একশো দিনের কাজ, কিংবা ক্যাটারিং। সুজয়ের আক্ষেপ, “এক দিনে তিন থেকে চারটি ম্যাচও খেলতে হয়। শরীরে কিছু থাকে না। কিন্তু না খেললে সংসার চলবে কী করে?”
হাওড়ার জগৎবল্লভপুরের শোভারানী কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সুরজিৎ মুর্মূ। তাঁর খেলা যাঁরা দেখেছেন তাঁরা বলেন, এ ছেলে বলকে কথা বলাতে পারে। কিন্তু সব সময় কি আর কথায় কাজ হয়? কলকাতার নীচের সারির দল মেসার্স ক্লাবে কিছু দিন প্র্যাকটিস করার পর আর ডাক আসেনি। পড়ার খরচ চালানোর জন্য নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে সুরজিৎ বেছে নেয় ‘খেপ খেলা।’ হাওড়ার বাইরে থেকেও এখন খেপ খেলার জন্য ডাক আসে সুরজিতের। তাঁর কথায়, “আট-দশটা ক্লাবের হয়ে খেপ খেলি। এতে নিজের পড়ার খরচটা চলে যায়।”
কী এই খেপ ফুটবল?
অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।
কলকাতা লিগ, জেলা লিগ, থানা লিগের বাইরে রয়েছে গ্রাম বাংলায় প্রচুর ক্লাব। যাঁরা মূলত জেলার বিভিন্ন শিল্ড কিংবা প্রতিযোগিতায় দল নামায়। আকর্ষণীয় পুরস্কারমূল্যর এই খেলাগুলিতে জেতার জন্য বাইরে থেকে ফুটবলার ‘ভাড়া’ করে ক্লাবগুলি। হাওড়ার বালি গ্রামাঞ্চল ক্লাবের কর্তা দিলীপ পালের মতে, “টাকার বিনিময়ে নিজের ক্লাবের বাইরে অন্য ক্লাবের হয়ে খেলাকেই ‘খেপ’ খেলা বলে।” ঝাড়গ্রামের প্লেয়ার্স কর্ণার ক্লাব দীর্ঘদিন ধরেই খেপ খেলোয়াড়দের দিয়ে দল করে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় খেলে। ওই ক্লাবের কর্তা বুদ্ধদেব মাহাতো জানালেন, “খেলোয়াড়ের মান অনুযায়ী আমরা টাকা দিই। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রও আমাদের দলে খেপ খেলে। আবার কলকাতা লিগের সুপার ডিভিশনের ক্লাব থেকেও অনেকে আসেন। বিদেশি ফুটবলাররাও (পড়ুন নাইজেরিয়ান) খেলেন।” তাঁর সংযোজন, “চাকরি নেই। ভালো ক্লাবে খেলার সুযোগও পাওয়া যায় না। তাই অনেকেই খেপ খেলাকেই নিজের পেশা করে নিচ্ছেন।”
খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ম্যাচ পিছু মেলে পাঁচশো থেকে হাজার টাকা। দল ফাইনালে উঠলে মেলে ‘বোনাস’। এছাড়াও পাওয়া যায় যাতায়াত ও খাওয়ার খরচ। ক্যানিংয়ের একটি খেপ দলের পরিচালক অনীশ মন্ডল জানালেন, “আমাদের এখানে যে টুর্নামেন্টগুলি হয় সেখানে সাধারণত ৪০,০০০ থেকে ৫০,০০০ টাকা পুরস্কারমূল্য থাকে। দলপিছু প্রবেশমূল্য থাকে ৫,০০০ থেকে ১০,০০০ টাকা।” গ্রাম-বাংলার অনেক জায়গাতেই ‘খেপ’ খেলাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন ফুটবলাররা। বিভিন্ন ক্লাবে টাকার বিনিময়ে তাঁরা খেলে চলেন ম্যাচের পর ম্যাচ। কিন্তু ক্লাব জেতার পর আর কেউ খোঁজ নেয় না তাঁদের। অনেক সময় খেলার মাঝে গণ্ডগোলে ম্যাচ বন্ধ হলে পারিশ্রমিকও মেলে না।
তবে, সংসার চালানোর জন্য খেপ খেলতে যেমন অনেকে বাধ্য হন, তেমনি কম আয়াসে দ্রুত টাকা রোজগারে খেপ খেলা ফুটবলারের সংখ্যাও কম নয়। মোহনবাগানের প্রাক্তন ফুটবলার দীপেন্দু বিশ্বাস বলেন, “খেপ খেলা একটা নেশা। যারা বেশি খাটতে চায় না তারাই খেপ খেলে। কিন্তু ভাল ফুটবলার হতে গেলে রোজ প্র্যাকটিস করতে হবে। না হলে বড় ক্লাবের নজরে পড়া সম্ভব নয়।’’ তাঁর আপেক্ষপ, খেপ খেলে জেলার অনেক প্রতিভা নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
জীবনের লড়াইয়ে প্রতিভা হেরে যাচ্ছে প্রয়োজনের কাছে।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.