|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
স্মৃতি, সত্তা আর আশ্রয়ের সন্ধানে
অনেকগুলো ছবি, অনেকগুলো দেশ, অনেকগুলো মানুষ। সকলেই
কোনও না কোনও ভাবে
ছিন্নমূল। আমাদের সকলেরই মতো।
কয়েকটি
সিনেমা আর নিজের জীবন মিলিয়ে দেখছেন।
শিলাদিত্য সেন |
কয়েক মাস আগের কথা। সে দিন পূর্ণিমা ছিল। এক আকাশ জ্যোৎস্না মাথায় নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পানাজির চার্চ স্কোয়ারে এসে দাঁড়াই। একটু এগোলেই আমার হোটেল। আবহাওয়া যেন ফুরফুরে বসন্ত, তবু একটু দূরে মাণ্ডবী নদী থেকে উঠে আসা এক অজানা বাতাসে জড়োসড়ো হয়ে যাই।
‘ঠান্ডা লাগে না ভাইসাব?’ অনভ্যস্ত হিন্দিতে যাঁকে শুধোই তিনি ব্যাঙ্কের প্রহরী, মাথা নেড়ে ‘না’ বলেন। জামার মধ্যে এফ এম রেডিয়ো, পুরনো হিন্দি ফিল্মের গান। প্রতি রাতে ছবি দেখে ফেরার সময় ওঁর দেখা পাই, গান শুনতে-শুনতেই কথা বলেন। মহারাষ্ট্রের কোলাপুর থেকে বাবা-মা-র সঙ্গে চলে এসেছিলেন গোয়ায়, তার পর এখানেই কাজকর্ম-সংসার সব। কত স্মৃতি, একটু একটু বলেন, আবার ডুবে যান গান-শোনায়। রাতের পাহারায় থাকা ওই মরাঠি মানুষটির স্মৃতির মতো আরও কত ছেড়ে-চলে-আসার স্মৃতি নিয়েই একগুচ্ছ ছবি এখনও সিনেমার উৎসবে! সতেরো বছর হল আসছি আন্তর্জাতিক উৎসবে, ভারত সরকারের ‘ইফি’, গোয়া-য়।
|
ঘর ছেড়ে |
‘আমিও আইগর-এর মতো এগারো বছর বয়সে ঘর ছেড়েছিলাম’, বলছিলেন ইভজেনি রুমান। ‘আইগর অ্যান্ড দ্য ক্রেনস জার্নি’, তাঁর নতুন ছবি। সে ছবিতে এগারো বছরের আইগরকে রুশ দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয় ইজরায়েলে। বাবা-মা-র বিচ্ছেদের কারণে মা তাকে নিয়ে যান নতুন দেশে। পাখি-বিজ্ঞানী বাবার কাছেই আইগর পরিযায়ী ক্রেনদের জীবন খুঁটিয়ে দেখতে শেখে, রাশিয়া থেকে তাদের আফ্রিকা উড়ে যাওয়ার কথা জানতে পারে। সদ্য জন্মানো একটি ক্রেনের নামও দেয়— কার্ল। কার্লের এক দেশ থেকে অন্য দেশে উড়ে যাওয়ার পাশাপাশি আইগরেরও দেশান্তরী হওয়ার গল্প। রুমান সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর সে-দেশ ছেড়ে সপরিবারে চলে আসেন ইজরায়েলে। ‘রাশিয়ার স্মৃতিতে এতটাই বুঁদ হয়ে থাকতাম যে নিজেকে কেমন আউটসাইডার মনে হত। আস্তে আস্তে নতুন দেশটাকেই নিজের দেশ মেনে নিলাম। আইগরও দেখবেন ছবিতে সব বাধা সরিয়ে নতুন দেশে নিজের বাঁচার রাস্তা খুঁজে নেয়। পরিযায়ী পাখি ক্রেনদের প্রতি অদম্য ভালবাসাই তাকে সে সাহস জোগায়।’ রুমানের কথা শুনতে শুনতে আমার পক্ষীপ্রেমী বন্ধুটির কথা মনে পড়ে যায়। সৌগত।
ক্লাস ওয়ান থেকেই একসঙ্গে পড়তাম, কিন্তু থ্রি থেকে যে বন্ধুত্বটা শুরু হল, তার মূলে ছিল সিনেমা। পরীক্ষার আগে রাশভারী দিদিমণি আর স্যারেরা সিলেবাস শেষ করতেন, জানালার ফাঁক দিয়ে হিমেল হাওয়ার পিঠে চেপে ঢুকে পড়ত নরম রোদ, আমরা দু’জন তন্ময় হয়ে সিনেমার গল্পে ডুবে যেতাম। বড় হয়ে আরও একটা নেশা জন্মাল সৌগতর: পরিযায়ী পাখি দেখা।
|
শরণার্থী |
ছেলেবেলায় শোনা পাখির ডাক বড় হয়ে কেমন পাগলের মতো খুঁজে বেড়াত সিদ্ধার্থ, এক দিন ক্লাসে গল্প করেছিলেন অপূর্ববাবু। আমরা তখন টেন-এ পড়ি। এক দিন গোটা পিরিয়ড ধরে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ দৃশ্যের পর দৃশ্য সাজিয়ে শুনিয়েছিলেন। শাসন-শৃঙ্খলায় অমন দুর্ভেদ্য আমাদের স্কুল, তাতে হঠাৎ বসন্তের হাওয়া! তার পর থেকে মনখারাপ লাগলেই সৌগত বলত: ‘চল্, স্যরের কাছে যাই।’ |
|
পানাজিতে এত বছর পর এক অপরাহ্ণে ফিলিপ ফালারদ্যু-র ‘মঁসিয় লাজহর’ (উপরের ছবি) দেখে স্কুলের দিনগুলো মনে পড়ে গেল। মন্ট্রিয়ল-এর একটা স্কুলে এক শিক্ষিকা হঠাৎ আত্মহত্যা করায় ছাত্রছাত্রীরা গভীর মনখারাপে ডুবে আছে, তখন তাদের পড়াতে এলেন বশির লাজহর। এমন ভাবে পড়াতে লাগলেন, ছেলেমেয়েরা মন খুলে কথা বলতে লাগল, ভুলতে শুরু করল তাদের মনখারাপ।
বশির আলজিরিয়ার অধিবাসী, কানাডার কোয়েবেক-এ শরণার্থী। রাজনৈতিক কারণে তাঁর স্ত্রী আর দুই সন্তানকে মেরে ফেলা হয়েছে আলজিরিয়ায়। পরিচয় গোপন করে ছেলেমেয়েদের পড়াতে এসেছিলেন বশির, ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতির উপশম খুঁজতে। নিজের অজান্তেই কখন যেন তাদের মানসিক শুশ্রূষার দায় তুলে নিয়েছিলেন, আর তাতেই আপত্তি অভিভাবকদের। লেখাপড়া শেখালেই তো হয়, ছেলেমেয়েদের মধ্যে আবেগ-অনুভূতি জাগিয়ে তোলার দরকার কী! বড় হয়ে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিল সৌগত।
শেষ পর্যন্ত ফাঁস হয়ে যায় বশির ‘রিফিউজি’, অভিভাবকদের আবেদনে সাড়া দিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ছাঁটাই করেন চাকরি থেকে। ফিলিপ জানিয়েছেন, তিনি একেবারে অন্য চোখ থেকে নিজেদের অবস্থানটা দেখাতে চেয়েছিলেন: ‘to talk about ourselves through the eyes of an immigrant.’ শেষ দিন ক্লাসে পড়াতে এসে গল্পচ্ছলে ফেলে-আসা দেশটার কথা বলেন বশির। ছবি শেষ হলে বেরিয়ে দেখি, সন্ধে নেমেছে। বিয়ারের গ্লাস হাতে সেজেগুজে রঙিন ঝলমলে উৎসব-চত্বর, সেখানে নিজেকে বড় দলছুট মনে হয়।
|
অনুপ্রবেশকারী |
বেটি-রও একা লাগত প্রথম-প্রথম, আফ্রিকা ছেড়ে সে যখন চলে এসেছিল ইউরোপে। হেঁটে ইউরোপে ঢোকার পর থেকেই সে ‘অনুপ্রবেশকারী’। টনি গ্যাটলিফ-এর ছবি ‘দ্য আউটরেজড’ কেবল ছিন্নমূল মানুষের কথা বলে। শুধুই পীড়ন-দুর্দশার কথা নয়, পাশাপাশি তাদের পুনর্বাসনের দাবিতে সংঘবদ্ধ হয়ে ওঠা, প্রতিবাদে শামিল হওয়ারও ছবি। ওই আফ্রিকার মেয়েটি বেটি-র চোখ দিয়েও দেখানো। বলেওছেন টনি সাক্ষাৎকারে: ‘I had to accept the point of view of an illegal immigrant.’
টনি মনেই করেন, ইউরোপীয় সমাজ প্রস্তুত নয় অনুপ্রবেশকারীদের ঠাঁই দিতে, ‘বেআইনি’ ছাপ্পা মেরে জেলে পোরা বা ভাগিয়ে দেওয়াই প্রশাসন-কর্তৃপক্ষের কাজ। অথচ, দেশ ছেড়ে-আসা মানুষগুলো আজও স্বপ্ন দেখে— ইউরোপ তাদের আশ্রয় দেবে, রক্ষা করবে।
উৎসবের শেষ দিন, ছবি দেখে বেরিয়ে হাঁটছি, রাত নেমেছে। মাণ্ডবীর মাথার উপর কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ। এত দিন যেন দেশান্তরী ছিলাম, এ বার ঘরে ফেরা। চাঁদটার দিকে তাকিয়ে ‘বিষণ্ণ’ শব্দটাই মনে হল কেবল।
কলকাতায় ফিরলেই ফোন আসত সৌগতর: ‘সিনেমা কেমন দেখলি?’ এ বার সে-ফোন আসেনি, বছর ঘুরতে চলল মারা গেছে সৌগত, আচমকাই। তার আগের সপ্তাহেও একসঙ্গে সিনেমা দেখেছিলাম আমরা।
এ মাসের শেষে সৌগতর মৃত্যুদিন। স্মৃতি ছাড়া কোথাও ফেরা যায় না! |
|
|
|
|
|