দৈনিক সংবাদপত্রের ভিতরের দিকের পাতায় সেঁধিয়ে থাকা খবর। তবু চোখ টানছে। এ-পাতা, সে-পাতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ধর্ষণের ‘ছোটখাটো নিউজগুলো’-র মধ্যে যাকে বলে ‘বিজ্ঞাপনী ব্যতিক্রম’। তাই একটু ফলাও করে গদগদ ভঙ্গিতে ছাপা। মানবিকতার পরাকাষ্ঠায় ছাপানো জ্বলজ্বলে শিরোনাম: ‘গণধর্ষিতা বান্ধবীকেই বিবাহ যুবকের’। অনেকেই আহ্লাদে দশখানা এই টুকরো খবর পড়ে। এই না-হলে ভাল খবর!
এই খবরে যত গভীর নিঃশ্বাস ফেলেছে জনতা, মেয়েটার একটা হিল্লে হল ভেবে, তার দ্বিগুণ উদ্বেগে আমার রাত ঘুমহীন। এ কোন ভবিষ্যতের বন্দনায় মুখর আমরা। এ তো আসলে সেই পিছনের দিকেই এগিয়ে যাওয়া। আমরা মেয়েরা যেটা চাইছি, বারবার চাইছি, গলা ফাটাচ্ছি যার জন্য, সে তো নিরাপদ আশ্রয় নয়, ‘নিরাপত্তা’। স্কুল-বাড়ি কিংবা নিজের বাড়ি, পাব কিংবা পিকনিট স্পট, স্থান-কাল-পাত্র যাই হোক না কেন, আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমাকে ছোঁয়ার কিংবা ছিঁড়েখুঁড়ে খাওয়ার কোনও অধিকার আমি কাউকে দিইনি। আমার এই অধিকারটুকুকে সম্মান করুক সকলে। তবে না মানুষের মতো মানুষ! |
গণধর্ষিত হওয়ার চার দিনের মাথায় বান্ধবীর পাণিগ্রহণ করল যে যুবকটি, তাকে আমরা মহাসমারোহে বসালাম ত্রাতার আসনে। আসলে ঠিক সেই মুহূর্তেই আমরা ততোধিক সাড়ম্বরে ধরে নিলাম মেয়েটি ‘নষ্ট’ হয়ে গেছে। আসলে নস্যাৎ করে দিলাম মেয়েটির যাবতীয় স্বতন্ত্র অস্তিত্বকে। সম্পর্ককে প্রাতিষ্ঠানিকতায় বেঁধে মেয়েটিকে উদ্ধারের এই আপাত-মহৎ দৃশ্যে আসলে আমাদের সেই ঘুণে ধরা পিতৃতন্ত্রের সংস্কারেরই প্রতিচ্ছবি।
অরিতা ভৌমিক অধিকারী। কলকাতা-৮৪
|
সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় (‘আঙুল তোলো, ঠিক আঙুল’, ১২-৬) ঠিকই বলেছেন, একটি ছেলে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যখন একজন মেয়ের সঙ্গে সহবাস করেন, কখনওই তা ধর্ষণ হতে পারে না। কারণ, সহবাস কালে দু’জনেই সমান যৌন আনন্দ উপভোগ করেছেন। এর পর প্রতিশ্রুতি মতো বিয়ে না-করাটা বিশ্বাস ভঙ্গ হতে পারে। কিন্তু কখনওই তা ধর্ষণ নয়। কারণ, মেয়েটি ইচ্ছার বিরুদ্ধে সহবাস করছেন না এবং ছেলেটিও তাঁকে জোর করছেন না। দেশের শীর্ষ আদালত তাই মনে করে বলেই রায় দিয়েছে, বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাস মানেই ধর্ষণ বলা যাবে না।
কিন্তু যখন উল্টোটা ঘটে? কোনও পুরুষ যদি এক জন মহিলাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাস করে থাকেন, তখন ভেবে নেওয়া যেতে পারে, সেই মহিলাও বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েই সহবাস করেছেন। এখন মহিলা যদি বেঁকে বসেন, বিয়ে করতে না-চান, সে ক্ষেত্রে ঘটনাটি তো মহিলার দিক থেকে বিশ্বাসভঙ্গের শামিল (যদিও এ রকম ঘটনার সংখ্যা কম, তবু এমনও ঘটে)। সে ক্ষেত্রে পুরুষটির মানসিক অবস্থা কী হয়? পুরুষটি কিন্তু এ ব্যাপারে থানায় অভিযোগ দায়ের করেন না, আদালতেও মামলা লড়েন না। কিন্তু কেন? কারণটা কি সেই পুরষটিরও সামাজিক ভয় বা লজ্জার নয়? আসলে পুরুষমাত্রই হবে লৌহকঠিন। নমনীয়তা, আবেগ পুরুষকে মানায় না। কোনও মেয়ে যদি দীর্ঘ দিন সহবাস করার পর কোনও পুরুষকে ছেড়ে চলে যান, তা হলে সেই পুরুষ সবার সামনে চোখের জল ফেলতে পারেন না। ফেললে বাড়ির মহিলারাই তাঁকে ম্যাদামারা বা মেয়েদের মতো বলবেন।
সঞ্চারীদেবী মেয়েদের পিতৃতন্ত্রের প্রোডাক্ট বলেছেন। আসলে নারীপুরুষ নির্বিশেষে আমরা ক্ষমতাতন্ত্রের প্রোডাক্ট। আমি এ রকম পরিবারও দেখেছি, যেখানে পরিবারের কর্ত্রী শেষ কথা। সেই পরিবারের পুরুষটি অক্ষরে অক্ষরে তার মায়ের কথা পালন করে। সেই পরিবারের গৃহবধূটি যখন লাঞ্ছিতা হন, তাঁকে অত্যাচার করা হয়, তখন পুরুষটির সঙ্গে সেই কর্ত্রীও শামিল হন। কিন্তু পরিবারের সেই কর্ত্রী রুখে দাঁড়ালে ওই গৃহবধূটিকে বাঁচানো যেত। এখানেও আসলে সেই ক্ষমতারই খেলা। পিতৃ বা মাতৃতন্ত্রের থেকেও বড় হয়ে ওঠে ক্ষমতাতন্ত্র, যা পরিবার এবং সমাজকে পরিচালনা করে।
রাজা পোদ্দার। কলকাতা-৫০ |