প্রবন্ধ ১...
বারাসত ও বঙ্গভূমি: একটু চিন্তা দরকার
বারাসতের উপর্যুপরি মর্মান্তিক ঘটনায় ওই জেলার নারীশিক্ষা নিয়ে দুটো স্মৃতি ফিরে এল। আমার চেনা এক দরিদ্র পরিবার হাবড়ার কিছু দূরে গ্রামে থাকেন। তাঁদের মেয়ে ছ’সাত বছর আগে আপার প্রাইমারি শেষ করল। বিরাট তল্লাটে একটিমাত্র স্কুল যাতে মেয়েদের নবম শ্রেণি আছে। সেখানে ভর্তির জন্য তৎকালীন শাসকদলকে পিতামাতার দু’হাজার টাকা শিক্ষাযৌতুক দিতে হয়েছিল। মাধ্যমিকের পর মেয়েটির লেখাপড়া তবু বন্ধ হয়ে গেল। উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল আরও বহু দূর। বাড়ির প্রবীণারা রায় দিলেন, মেয়ের অত দূর যাওয়া অসম্ভব, ‘লোকের নজর লাগবে’। প্রাগৈতিহাসিক সংস্কারে ইন্ধন জোগাল প্রবল ভাবে সমসাময়িক পাপাচার, যার প্রমাণ আজও ফি-হপ্তা মিলছে।
অন্য কাহিনিটা এক দরদি ও কর্মঠ শিক্ষাপ্রশাসকের। অন্য সব জেলার মতো এখানেও কলেজগুলিতে নির্ধারিত সংখ্যার অনেক বেশি ছাত্র ভর্তি হয়। প্রতিকারে নেমে তিনি ধর্মসংকটে পড়লেন। অতিরিক্তদের একটা বড় অংশ মেয়ে দরিদ্র, প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী, প্রায়ই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। পরীক্ষার নম্বর ভাল নয়, কড়াকড়ি করলে এদের উপরই বেশি কোপ পড়বে। কিন্তু এরা যে আদৌ লেখাপড়া করছে, সমাজে বেরোচ্ছে, দুনিয়াটা চিনছে, এতেই তাদের ও তাদের সমাজে একটা নীরব বিপ্লবের ক্ষীণ সূচনা হয়েছে।
সাম্প্রতিক শিউরে-ওঠা ঘটনাগুলির সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি কুফল, এতে মেয়েদের পড়তে বেরোনোয় একটা বিরাট বাধা সৃষ্টি হল। তাৎক্ষণিক আতঙ্ক কাটলে বর্তমান ছাত্রীরা প্রায় সকলেই হয়তো স্কুল-কলেজে ফিরে যাবে। কিন্তু সমাজের যে বৃহদংশে মেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে সংশয় কাটেনি বা রীতিমত বিরোধ আছে, সেখানে অপরিমেয় ক্ষতির সম্ভাবনা।
যে মেয়েরা পড়তে যাবে, তারাও যাবে কী ভরসায়— আশা-স্বপ্নের কথা ছেড়েই দিলাম? বাইরের জগতের সঙ্গে যদি সম্পর্ক না ঘটে, স্বাধীনতা আত্মপ্রত্যয়ের প্রথম পাঠ না-ই মেলে, ভয়ে-ভয়ে বন্ধ ঘরে বই মুখস্থ করে শিক্ষার দুধে কতটা জল মিশবে? তাদের লেখাপড়া কি নির্ভর করবে কোনও পুরুষ আত্মীয় তাদের আগলে স্কুলে নিয়ে যাবার উপর? নারীশিক্ষা কি পুরুষতন্ত্রকে আরও কায়েম করবে কপাল ভাল থাকলে রক্ষাকর্তা পিতা-ভ্রাতার মাধ্যমে, না থাকলে গুন্ডা-বদমায়েশের হাতে?
এটা জনমত ও গণচেতনার বিষয়, পরিসংখ্যানের নয়: পুলিশের ডিজি সাহেব ঠিকই বলেছেন, ‘পারসেপশন’-এর ব্যাপার। তাঁর দুর্ভাগ্য, এই মর্মে তাঁর যে পাশ-কাটানো নিরুত্তাপ উক্তি রাজ্যবাসী টিভিতে দেখলেন, তাতে তাঁদের পারসেপশন আরও বহু মাত্রায় নেতিবাচক হয়ে পড়ল যেমন অনেক দিন ধরেই হচ্ছে নেতৃবর্গের নানা বিচিত্র প্রতিক্রিয়ায়।
আসল কথা, সব শাসকগোষ্ঠীই তাঁদের রাজত্বে অন্যায়-অনাচার ঘটলে সেটা মূলত দেখেন রাজনৈতিক আপদ বা আক্রমণ হিসাবে; ঘটনায় যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত এমনকী বিধ্বস্ত হলেন, তাঁরাও তাই রোষানলে পতিত হন, তাঁদের সমব্যথীরা তো বটেই। নেতাদের মানবিক উচ্চারণ বা উন্নয়নমূলক কাজও সচরাচর নিঃসৃত হয় রাজনৈতিক তাগিদে। মাকিয়াভেল্লি-র যে কালজয়ী গ্রন্থের পাঁচশো বছর পূর্ণ হল, তার একটা বড় বক্তব্য রাজপুরুষের সদয় বা প্রজাবৎসল হবার দরকার নেই, হবার ঠাট বজায় রাখাই জরুরি। প্রজাদেরও এর বেশি আশা করা অবাস্তব, কিন্তু গণতন্ত্রের যুগে অন্তত এটুকু শুধু আশা নয়, দাবি করা চলে।
তাই প্রশ্ন করতেই হয়, নির্বাচিত নেতা-নেত্রী তো বটেই, করপুষ্ট প্রশাসক ও আধিকারিকদের উক্তি-আচরণ আরও সদর্থক, ইতিবাচক হবে না কেন? পঁয়তাল্লিশটার মধ্যে একটা দ্রুত-আদালত গঠিত হয়েছে, তিনটি ধর্ষণ-মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে, ভাল কথা, কিন্তু যথেষ্ট নয়। আগের মামলাগুলো? যে পুলিশের বিরুদ্ধে গুরুতর অবহেলা বা দুষ্কর্মের অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত কোন পর্যায়ে? মুর্শিদাবাদে সম্ভাব্য ধর্ষণের সদ্য মামলায় অভিযোগ নিতে দেরি করা, সাদা কাগজে সই করানোর মারাত্মক অভিযোগ প্রকাশিত হয়েছে। অভিযোগ সত্য হলে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা, মিথ্যা হলে বিশ্বাসযোগ্য ভাবে জনগণকে তা জানিয়ে দেওয়ার আশু প্রয়োজন। নইলে বিভ্রান্তি ও অবিশ্বাস বাড়তেই থাকবে।
নিছক কথার স্তরেই, উচ্চ নেতৃত্বের একের পর এক যে অমানবিক ও তথ্যবিরুদ্ধ উক্তি কিংবদন্তির আকার ধারণ করেছে এবং অবশ্যই সমাজের দুর্বৃত্তায়নে ইন্ধন জুগিয়েছে, নির্যাতিতাদের অবদমিত ও আপামর সজ্জন ব্যক্তিকে নিরাশ করেছে— সেগুলি ধুয়েমুছে নতুন বার্তা পাঠাবার কোনও ইঙ্গিত এসেছে? জনগণ তো বটেই, প্রশাসনকর্মীদের কাছেও এই বার্তাগুলির চূড়ান্ত তাৎপর্য। এই বৃহত্তর অভিজ্ঞতা ও বাতাবরণ থেকেই তাঁরা বুঝে নেন কী হবে বা হবে না, কী করা চলবে বা চলবে না।
এখানেও সেই রবীন্দ্রনাথ এসে পড়েন। ধর্ষিতা খুন-হওয়া মেয়ের কথাও তিনি লিখে রেখে গেছেন। সেই ঘটনায় তাঁর ঈশ্বরবাদ মঙ্গলবাদ অন্তত সাময়িক ভাবে টলে গিয়েছিল: ‘‘উপায় নাই রে, নাই প্রতিকার’ বাজে আকাশ জুড়ে।’’ এমন ঘটনা শুনলেও একটা গ্লানিকর অসহায়তা, একটা সার্বিক নৈরাশ্য জেগে ওঠে। সেটা যত ক্ষণ না দূর হচ্ছে, তথ্য-পরিসংখ্যানের খড়কুটো হবে নৈতিক নিঃস্বতার অবলম্বনমাত্র।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এই নৈতিক নিঃস্বতার ইতিহাস বড় দীর্ঘ। পশ্চিমবঙ্গে জনশিক্ষার আয়োজন বরাবর অপ্রতুল: নিছক স্কুলের বা আসনের অভাবে বহু ছেলেমেয়ের (বিশেষত মেয়ের) শিক্ষায় ছেদ পড়ে। স্কুলশিক্ষক নিয়োগে পূর্বেকার দুর্নীতির খতিয়ান লজ্জাকর, উপরন্তু অবহেলা ও রাজনৈতিক অবিমৃশ্যকারিতায় কয়েক অযুত শিক্ষক পদ খালি। রাজ্যের ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত সে দিনও সর্বভারতীয় শোচনীয় মাত্রার দ্বিগুণ শোচনীয় ছিল। স্কুলশিক্ষার উন্নতির জন্য বর্তমান সরকার নানা ঘোষণা করেছেন, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে (যেমন শিক্ষক নিয়োগে, বা কিছু স্কুলের স্তর-উন্নয়নে) বাস্তব পদক্ষেপও করছেন। কিন্তু বাহ্যিক বাধা ও অনাচারে যদি শিক্ষার্থীরাই গুটিয়ে যায়, স্কুলের ভীতির স্থান নেয় স্কুলের রাস্তার ভীতি, এ সব প্রস্তুতি কতটা ফলপ্রসূ হবে?
ঘটনার পর কামদুনির জন্য স্কুল, কলেজ, রাস্তার বাতি প্রভৃতি একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতি শোনা গিয়েছে। রূপায়িত হলে অবশ্যই ভাল কথা। আগামী দিনে ত্রিফলা বাতি না-হয় এ সব রাস্তাতেই বসুক। কিন্তু স্কুলটা কি সত্যিই স্কুল হবে, না স্কুলের শিখণ্ডীমাত্র? আর কলেজ? পরিকল্পনা ও অর্থসংস্থান ছাড়া রাজ্য জুড়ে যে কলেজ-ঘোষণার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তার নবতম সংযোজনে কতটা লাভ হবে কামদুনির? ক’টাই বা হবে এমন কলেজ? সম্ভাব্য কামদুনি তো রাজ্য জুড়ে নির্জন রাস্তা, অপরাধপ্রবণ অঞ্চল, আরও ঢের বেশি প্রত্যন্ত অবস্থান। আমাদের উচ্চশিক্ষার প্রসার কি খুন-ধর্ষণের মানচিত্র ধরে এগোবে?
তার চেয়ে একটু ব্যাপক ও পরিকল্পিত ভাবে দু-একটা কথা ভাবা যায় কি? একটি অবশ্যই ছাত্রীবাস-নির্মাণ। এটা কেবল নিরাপত্তার তাগিদে নয়, আবাসনের সুবিধা থাকলে দরিদ্র বা প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েদের (ছেলেদেরও) শিক্ষার সুযোগ লক্ষণীয় ভাবে বাড়ে, দরিদ্রদের ন্যূনতম আহার ও পড়াশোনার পরিকাঠামো জোটে। রাজ্যে হঠাৎ একটি মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষিত হল। একুশ শতকে তার প্রয়োজন, এমনকী কাম্যতা গভীর বিতর্কের বিষয়। বরং ওই টাকা দিয়ে নবম শ্রেণি থেকে কলেজ স্তর পর্যন্ত চালু শিক্ষায়তনে কিছু ছাত্রীবাস গড়লে আখেরে নারীশিক্ষার প্রসার ঘটত ঢের বেশি।
বলা বাহুল্য, অধিকাংশ মেয়ে স্বগৃহে থেকে লেখাপড়া করবে, সেটাই স্বাভাবিক ও বাঞ্ছনীয়। শিশুদের ক্ষেত্রে তো তেমনটা হতেই হবে। তাদের স্কুল যাতায়াতের জন্য বিশেষ বাস চালু করা যায় না? পঞ্চায়েত থেকে স্থানীয় বাসমালিকদের সঙ্গে কথা বলে, নির্দিষ্ট মাসিক অর্থের বিনিময়ে এমন ব্যবস্থা হতে পারে। সাইকেল দিলে অবশ্যই আরও সুবিধা হয়। নীতীশ কুমার এই উপায়ে বিহারের গ্রামের মেয়েদের শিক্ষায় জোয়ার এনেছেন। কিন্তু নির্জন রাস্তায় সাইকেল নিরাপদ যান নয়, সকলকে দেওয়াও সম্ভব নয়, আর কচিকাঁচাদের ক্ষেত্রে মোটেই চলবে না। বাস-ব্যবস্থার কথা তাই গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত। এটা একটা সীমিত ব্যবস্থা, মেয়েদের স্বাধীনতা ও প্রত্যয়বোধের চাহিদা মেটাবে না, কিন্তু সুষ্ঠু ও নিরাপদ ভাবে পড়তে যাওয়াটুকু সুনিশ্চিত করবে। তা থেকেই ক্রমশ অন্য সুযোগ ও স্বাধীনতার দাবি উঠবে। সেই দাবি মানতে সমাজ ও সরকার প্রস্তুত কি না, সেটাই প্রশ্ন।
যে বোনের রক্ষায় এই বারাসতেই ষোলো বছরের রাজীব দাস প্রাণ দিয়েছিল, সেই মেয়েটি ক’দিন আগে বড় সাহসী, বড় বেয়াড়া একটা কথা বলল। বলল, কই, বড় বড় নেতা-আমলাদের মেয়েরা তো ধর্ষিত হয় না! পৃথিবীর অন্য সব মেয়েদের মতো তাদের জন্যও প্রার্থনা, যেন না হয়। কিন্তু যদি এমনটা ঘটত, উচ্চ মধ্যবিত্তের নাভিমূল থেকে স্বতঃপ্রবৃত্ত ভয়, ক্ষোভ ও প্রতিবাদ উগরে উঠে শহর ভাসিয়ে দিত। এই নেতা প্রশাসকদের বিবৃতির সুর পালটে যেত, ‘অ্যাকশন’-এর বন্যা ডাকত। ভদ্রজনমাত্রে সরব হতেন, বিদ্বজ্জনদের দরকারই পড়ত না। আপাতত তাঁদের হাতে, বা দু-চারটি নারী-সংগঠনের হাতে, প্রতিবাদের দায় তুলে বাকি সমাজ একটু মনখারাপ করে বিবেক হালকা করছেন।
‘ওরা-আমরা’র আসল বিভেদটা তৃণমূল-সিপিএমের মধ্যে নয়, সবল ও দুর্বল, সবাক ও নির্বাকের মধ্যে। সেই সঙ্গে একটা অযৌক্তিক বিভেদ, যার এক দিকে টিভির পর্দায় দেখা ভিন্ন জগতের অজানা মানুষগুলো, যাদের যা কিছু অনাচার-অনিষ্ট ঘটতে পারে, অন্য দিকে দর্শকের কেদারায় ‘আমরা’ বিধির আশিসে নিরাপদ, নিরঙ্কুশ, তাই ‘ওদের’ নিয়ে বিশেষ না ভাবলেও আমাদের চলবে।
বিধির হিসেব গুলিয়ে গিয়ে আমরা যে কেউ কিন্তু হঠাৎ এক দিন পর্দার ও পারে চলে যেতে পারি। একটু মমত্ব, একটু চিন্তা, একটু পরিকল্পনা তাই না হলেই নয়।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এমেরিটাস অধ্যাপক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.