|
|
|
|
|
সচেতনতা না বাড়লে
কমবে না নারী-নিগ্রহ
পরমা দাশগুপ্ত • কলকাতা |
|
দিল্লি থেকে কামদুনি অনেক অনেক দূর।
দিল্লির সঙ্গে কামদুনির মিলও নেই কোত্থাও।
তবু একটা সরলরেখায় জুড়ে দেওয়া যাচ্ছে দুটো বিন্দু। নৃশংসতার রেখায়। যে নৃশংসতা থাকলে গণধর্ষণের মতো বীভৎসতা পেরিয়েও থামা যায় না। ক্ষতবিক্ষত নারী শরীরটায় তার পরেও ঢুকিয়ে দেওয়া যায় মরচে ধরা লোহার রড, কিংবা টেনে চিরে ফেলা যায় দুটো পা।
সাম্প্রতিক অপরাধের খতিয়ান বলছে, এখন স্রেফ গণধর্ষণেই থেমে থাকছে না দুষ্কৃতীরা। আরও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অত্যাচারের মাত্রা। কোথাও অজ্ঞান অবস্থাতেই চলছে ধর্ষণ। কোথাও আবার প্রমাণ লোপের চেষ্টায় খুন করা তো বটেই, এমনকী অত্যাচার সইতে না পেরে মেয়েটির মৃত্যু হলে তার নিথর শরীরটা নিয়েও চলছে নতুন করে অত্যাচার।
ধর্ষণের পরেও নতুন করে অত্যাচারের এই বীভৎসতা কেন? মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যালের মতে, মনোবিকারগ্রস্ত না হলে এমন বীভৎসতা সম্ভব নয়। তাঁর কথায়, “এ ক্ষেত্রে এক দিকে যেমন কাজ করছে বেপরোয়া মানসিকতা, তেমনই শিকারকে যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখাটা তাদের এক রকমের আনন্দ দিচ্ছে। মেয়েদের উপরে বলপ্রয়োগ করাটা তাদের কাছে ক্ষমতার বোধ। শুধু ধর্ষণ করার যৌনতৃপ্তি নয়, এই বাড়তি অত্যাচারটা তাদের একটা বাড়তি আত্মতৃপ্তি দেয় তারা এতটাই ক্ষমতাবান যে শুধু যৌনসংসর্গ নয়, তারা চাইলে নারী শরীরটাকেই ধ্বংস করে ফেলতে পারে। লোহার রডটা তখন তাদের কাছে পুরুষকারের প্রতীক, পা টেনে চিরে ফেলাটা সেই ক্ষমতার প্রদর্শন। পৌরুষ বোধের খামতিটা যাদের খুব তীব্র, তারাই এমন ঘটাতে পারে।”
কিন্তু এমন একটা প্রবণতা তৈরি হল কী করে?
সমাজতাত্ত্বিক অভিজিৎ মিত্র মনে করেন, সর্বত্র মেয়েদের ‘সেক্স অবজেক্ট’ হিসেবে দেখানোর ফলে ক্রমশ এমন একটা ধারণা তৈরি হয়ে যাচ্ছে যে তৃপ্তি বা আনন্দের একমাত্র উৎস যৌনতাই। যৌনতাই হয়ে দাঁড়িয়েছে ন্যায্য, স্বাভাবিক দাবি। আর সেটা সহজে পাওয়া সম্ভব না হলেই দল ভারী করে গণধর্ষণের পথে হাঁটছে এক দল মানুষ। কারণ, এক দিকে যেমন দলবদ্ধ ভাবে একটা মেয়ের উপরে অত্যাচার চালানোটা সুবিধাজনক হয়, তেমনই একটিই মেয়ের সঙ্গে পরপর যৌনসংসর্গের মাধ্যমে স্বাভাবিক যৌনতার পাশাপাশি সমকামিতার তৃপ্তিও মেলে। তার পরেও তারা বাড়তি অত্যাচারের পথে হাঁটছে কারণ পৌরুষ চরিতার্থ করার বৃত্তটা তা না হলে যেন সম্পূর্ণ হচ্ছে না। শিকারের উল্লাসে মেয়েটিকে মেরে ফেলতেও তাদের এতটুকু হাত কাঁপছে না।
অভিজিৎবাবুর মতে, এর সঙ্গেই যোগ হয়েছে, যেনতেনপ্রকারেণ যা চাই, তা পাওয়ার আকাঙ্খা, সামাজিক বোধ, মূল্যবোধ ক্রমশ লোপ পাওয়া। প্রশাসনিক নজরদারির ফাঁক, এই ধরনের দুষ্কৃতীদের সহজে ধরা না পড়া এবং তেমন শাস্তি না হওয়াও ধর্ষণকারীদের সাহস জোগাচ্ছে, বেপরোয়া করে দিচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
লিগাল এড সার্ভিসেস, ওয়েস্ট বেঙ্গল-এর এগ্জিকিউটিভ চেয়ারম্যান, আইনজীবী গীতানাথ গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন, “আইন আইনের পথে চলছে। আমি মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে নই। তবে ভারতীয় দণ্ডবিধিতে ‘রেয়ারেস্ট অফ রেয়ার’ কেসে মৃত্যুদণ্ডের নিয়মও রয়েছে। এ ছাড়া, অপরাধের গুরুত্ব বুঝে আছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। কিন্তু এর কোনওটাই সমাধান নয়। আইন করে মূল্যবোধ, সামাজিক বোধ ফেরানো যায় না। তার জন্য সামাজিক সংস্কারের প্রয়োজন।” তাঁর মতে, সাময়িক উন্মত্ততায় আক্রান্ত না হলে এমন বীভৎস অপরাধ সম্ভব নয়। তবে পরিস্থিতিই মানুষকে অপরাধী বানায়। এখনকার সমাজে দুর্নীতি, অতিরিক্ত ক্রোধ, ধৈর্যহীনতা, অতৃপ্তি, মূল্যবোধ বা সামাজিক বোধের অভাবের মতো সমস্যা গেড়ে বসেছে। তার হাত থেকে সমাজকে বাঁচাতে সমাজতাত্ত্বিক বা মনোবিদদেরই পথ বাতলাতে হবে। সে কথা মানছেন অভিজিৎবাবুও। তাঁর মতে, সমাজ এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে মূল্যবোধ, নীতিবোধ সবই হারাতে বসেছে। যা চাই, তা হস্তগত করতে নৃশংসতার পথে হাঁটতেও এই দুষ্কৃতীরা পিছপা হচ্ছে না। তাঁর মতে, এ অবস্থাটা থেকে বেরিয়ে আসতে সবাইকেই উঠেপড়ে লাগতে হবে। মোমবাতি মিছিল, পথেঘাটে, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে বিক্ষোভ-আন্দোলনের সাময়িক প্রতিবাদ নয়, দরকার জনজাগরণ। প্রশাসনের নজরদারি, আইনের ব্যবহারের পাশাপাশি, সচেতন হতে হবে সাধারণ মানুষকেও। তবেই এ অবস্থাটার মোকাবিলা করা সম্ভব। |
|
|
|
|
|