পরশু মিছিলের ডাক
কামদুনির জেদকেই প্রেরণা করে পথে নামতে প্রয়াসী বিশিষ্ট মহল
বশেষে ঘুম ভাঙছে কলকাতার। যার পিছনে কামদুনির একরোখা জেদের ভূমিকার কথাও মানছেন শহরের বিশিষ্টজনদের একাংশ।
মহানগরের উপকণ্ঠে বারাসতের গ্রামটিতে এক কলেজছাত্রীকে ধর্ষণ ও নৃশংস ভাবে হত্যার পরে তাঁর পরিবার ও গ্রামবাসী সরকারি সাহায্যের যাবতীয় প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে দোষীদের চরম শাস্তির দাবিতে অনড়। এমনকী, খোদ মুখ্যমন্ত্রীর ডাকে মহাকরণে এসেও তাঁরা তাঁকে জানিয়ে দিয়ে গিয়েছেন, চাকরি-ক্ষতিপূরণ কিছুর দরকার নেই, তাঁরা শুধু চান দুষ্কৃতীদের ফাঁসি। সে ক্ষেত্রে রাজনীতির রং দেখতেও তাঁরা নারাজ।
এক দিকে অখ্যাত গ্রামবাসীরা যখন এমন বলিষ্ঠ সংকল্পে অটল, তখন ঘটনাটির বেশ ক’দিন পরেও কলকাতার নাগরিক জনমানসে প্রতিবাদ সে ভাবে দানা বাঁধেনি বলে অভিযোগ ক্রমশ জোরদার হতে শুরু করেছিল। তবে এ বার ছবিটা পাল্টানোর ইঙ্গিত মিলেছে। কামদুনির সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের সাহসকেই প্রেরণা হিসেবে তুলে ধরে পথে নামার ডাক দিয়েছেন শহরের বিশিষ্টজনদের একটি অংশ। শঙ্খ ঘোষ, নবনীতা দেবসেন, মহাশ্বেতা দেবী, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, মৃণাল সেন প্রমুখের স্বাক্ষর-সংবলিত বিবৃতিতে আগামী ২১ জুন, শুক্রবার বিকেলে কলেজ স্কোয়ারে এক প্রতিবাদ-মিছিলের ডাক দেওয়া হয়েছে।
কী বলছেন ওঁরা?
মঙ্গলবার শঙ্খবাবু বলেন, “কামদুনি একটা না বলতে পেরেছে, এটা খুবই বড় ব্যাপার। ঘটনাটির পরে সরকারি সাহায্য বা ক্ষতিপূরণের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে তাঁরা দোষীদের শাস্তি চেয়েছেন।” বর্ষীয়ান কবি অবশ্য এ-ও মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, নিছক প্রশাসনের বিরোধিতা করতে মিছিল ডাকা হয়নি। সামগ্রিক ভাবে সচেতনতা গড়ে তোলাই তাঁদের লক্ষ্য। “এই মিছিল একটা সামাজিক প্রতিরোধ। দুষ্কৃতীরা যেন না-ভাবে যে, তারা যখন-তখন, যা খুশি করতে পারে। এ হল সেই বার্তা পৌঁছে দেওয়ারও মিছিল।” বলেন তিনি। আর বিবৃতিতে সই না-থাকলেও অপর্ণা সেন জানিয়েছেন, তিনি মিছিলে হাঁটবেন। “যা ঘটেছে, তা জেনে ঘেন্না হচ্ছে।” মন্তব্য তাঁর।
কলকাতার রাস্তায় নারী নির্যাতন বিরোধী মঞ্চ ‘মৈত্রী’র মিছিল। মঙ্গলবার। ছবি: সুদীপ আচার্য।
শুক্রবারের প্রস্তাবিত মিছিলের নেপথ্যে রয়েছে ২২টি গণসংগঠন। আয়োজকেরা জানিয়েছেন, কামদুনি-কাণ্ডের পরে বিবৃতিটি শঙ্খবাবুই লিখেছেন। তাতে বলা হয়েছে, ‘রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় প্রতি দিনই চলছে বেপরোয়া নারী নিগ্রহ, ধর্ষণ আর হত্যার তাণ্ডব। দুষ্কৃতকারীদের আচরণ দেখে মনে হয়, তারা ধরেই নিয়েছে, তাদের শাসন করার কেউ নেই, যে কোনও কুকীর্তিরই অধিকার আছে তাদের।’ রাজ্য জুড়ে তৈরি হওয়া এ হেন ‘আতঙ্কের আবহে’ প্রশাসন কোনও ব্যবস্থা নিতে না-পারলে ‘ভয়াবহ বিপর্যয়’ দেখা দেবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে বিবৃতি বলছে, ‘শুধু প্রশাসনিক ব্যবস্থা নয়, আমরা এ-ও মনে করি যে, চারদিকের এই অপশক্তির বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে প্রবল এবং সংগঠিত সামাজিক প্রতিরোধ।’
পাশাপাশি সংগঠকেরা দৃঢ় ভাবে জানিয়েছেন, মিছিলে কোনও রাজনৈতিক পতাকা থাকবে না। দলমত নির্বিশেষে ‘রাজনীতির উর্ধ্বে’ ওঠার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘বিভেদ ভুলে সবাইকে একত্র হয়ে প্রতিবাদ জানাতে হবে আজ, দলীয় রাজনীতির বাইরে এসে স্বতঃস্ফূর্ত যে প্রতিবাদের পথ দেখিয়েছেন কামদুনিরই সাধারণ মানুষজন।’ রাজ্যের শাসকদল অবশ্য উদ্যোগটির মধ্যে রাজনীতির গন্ধ পাচ্ছে। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের কথায়, “এর আগে বুদ্ধিজীবীরা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পথে নেমেছিলেন। কিন্তু এখন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নেই। পরিস্থিতি যদি খুব খারাপ হলে বলার কিছু থাকত না।” মুকুলবাবুর দাবি, “পঞ্চায়েত ভোটের আগে রাজনৈতিক কারণেই ওঁরা পথে নামছেন।”
ঐক্যবদ্ধ হওয়া নিয়ে ধন্দ রয়েছে বিশিষ্টজনদের একটি মহলেও। শাসকদলের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত নাট্যকর্মী অর্পিতা ঘোষের সঙ্গে এ দিন যোগাযোগ করা হলে তিনি এ প্রসঙ্গে কিছু বলতে চাননি। মিছিলের আহ্বান সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া চাওয়ায় এ দিন বিকেলে তাঁর মন্তব্য, “সন্ধ্যায় নাটকের রিহার্সাল। অন্য ব্যস্ততাও আছে। তাই আমি এ নিয়ে কিছু বলতে পারছি না।”
বস্তুত নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর পর্বের সময় থেকেই বাংলার সংস্কৃতিজগত কার্যত দ্বিধাবিভক্ত। এ ক্ষেত্রেও তার কিছুটা প্রতিফলন উপস্থিত। যেমন, মিছিলে শঙ্খবাবুর সম্ভাব্য উপস্থিতিকে ‘ইতিবাচক ঘটনা’ হিসেবে অভিহিত করে, এবং উদ্যোগের প্রতি নৈতিক সমর্থনও ব্যক্ত করেও নাট্যকর্মী কৌশিক সেন জানিয়ে দিয়েছেন মিছিলে হাঁটতে তাঁর ব্যক্তিগত অপারগতার কথা। কৌশিকবাবু বলেন, “আমি এবং আরও কয়েক জন গত শনিবার কামদুনিতে মেয়েটির বাড়িতে গিয়েছিলাম। কিন্তু এই মিছিলে যাঁরা হাঁটবেন, নন্দীগ্রাম-কাণ্ডের পরে তাঁদের অনেকেরই অবস্থান আমি মন থেকে মানতে পারিনি। ওঁরা থাকলে আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়।”
নন্দীগ্রাম-কাণ্ডের পরেও যাঁরা তদানীন্তন বাম সরকারের পাশে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, মৃণাল সেন ছাড়াও তরুণ মজুমদার, সব্যসাচী চক্রবর্তীরা বিবৃতিতে সই করেছেন। সৌমিত্রবাবু বলেন, “চেষ্টা করব মিছিলে নিজে থাকতে। তবে শরীর খুব ভাল নেই। নিজে থাকতে না-পারলেও আমার নৈতিক সমর্থন থাকবে।” সব্যসাচীবাবুর দাবি, “এই মিছিলের মধ্যে কোনও বামপন্থী চক্রান্ত নেই। সে দিক দিয়ে দেখলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও তো বামপন্থী! আমি অন্তত চাই না, কোনও রাজনীতির লোক এতে থাকুন।” মিছিলের অন্যতম আহ্বায়ক, প্রবীণ অর্থনীতিবিদ তরুণ সান্যালের মন্তব্য, “শুনেছি, মিছিলে কয়েক জনের উপস্থিতি নিয়ে কারও কারও মধ্যে প্রশ্ন আছে। এ সব সংশয় অবান্তর। হিটলারের বিরুদ্ধে তো আমেরিকা-সোভিয়েত ইউনিয়ন একজোট হয়েছিল!” সাম্প্রতিক অতীতে বার কয়েক বর্তমান সরকারের প্রশংসা করলেও মহাশ্বেতাদেবী বিবৃতিতে সই করেছেন, যদিও অসুস্থতার কারণে অশীতিপর লেখিকা মিছিলে থাকতে পারবেন কি না বলা যাচ্ছে না। নবনীতা দেবসেন বিদেশে গেলেও মিছিলের প্রতি তাঁর নৈতিক সমর্থন থাকছে।
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের পরে গঠিত শিল্পী-সাংস্কৃতিক-বুদ্ধিজীবী মঞ্চ (তরুণবাবু যার সভাপতি) ও নারী নিগ্রহ বিরোধী কমিটির তরফে কাল, বৃহস্পতিবার কলেজ স্ট্রিটে বিদ্যাসাগর মূর্তির সামনে একটি সমাবেশ ডাকা হয়েছে। তরুণবাবু জানান, সেখানেও উপস্থিত সকলকে বলা হবে শুক্রবারের মিছিলে যোগ দিতে। তিনি বলেন, “কামদুনি যে ভাবে রাজনৈতিক ভাবে প্রভাবশালী দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, সেটাই আমাদের প্রেরণা।” এ দিন বিকেলে নারী নির্যাতন বিরোধী মঞ্চ ‘মৈত্রী’র তরফে একটি মিছিল ধর্মতলার মেট্রো চ্যানেল থেকে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস পর্যন্ত যায়। তাতে পা মিলিয়েছিলেন পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ডের ধর্ষিতা মহিলাও।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.