রিজওয়ানুর রহমানের মৃত্যু পরবর্তী ঘটনায় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ভূমিকা তদন্ত করে দেখতে চায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। মহাকরণ সূত্রে এমনই ইঙ্গিত মিলেছে। বর্তমান সরকারের অভিযোগ: রাজ্যের তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে বুদ্ধদেববাবুই নাকি রিজ-কাণ্ডে ‘প্রকৃত দোষী’ এক পুলিশ-কর্তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন!
অতি সম্প্রতি নন্দীগ্রাম কাণ্ডে বুদ্ধবাবুকে ছাড় দিয়েছে সিবিআই। তারা জানিয়েছে, ওই ঘটনায় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তেমন সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই। কিন্তু বর্তমান সরকার মনে করে, সিবিআই আসল দোষীদের রেহাই দিয়েছে। প্রশাসনের এক কর্তার কথায়, “নন্দীগ্রামে গুলিচালনার মামলায় গব্বরদের রেহাই দিয়ে সাম্বা-কালিয়াদের শূলে চড়াতে চাইছে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা!” একই ভাবে রিজওয়ানুর কাণ্ডের পরে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীও কলকাতার তদানীন্তন পুলিশ কমিশনারকে শাস্তি না-দিয়ে তাঁর পরিত্রাণের ব্যবস্থা করেছিলেন বলে মহাকরণের দাবি। প্রশাসনিক-সূত্রের ইঙ্গিত, বুদ্ধদেববাবুর ওই ভূমিকা সম্পর্কেই এখন তদন্তের তোড়জোড় করছে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে থাকা স্বরাষ্ট্র দফতর। কোন যুক্তিতে?
স্বরাষ্ট্রের এক কর্তার ব্যাখ্যা, “জেসিকা লাল হত্যাকাণ্ডের পরে রিজওয়ানুরের মৃত্যু দেশে যথেষ্ট আলোড়ন ফেলেছিল। এমন গুরুত্বপূর্ণ মামলায় আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও কলকাতার তৎকালীন পুলিশ কমিশনার প্রসূন মুখোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অথচ সরকারি ভাবে ২০০৮-এর ২৪ সেপ্টেম্বর পুলিশ কমিশনারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরুর সিদ্ধান্তে সিলমোহর দিয়েছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীই।” কর্তাটি এ-ও জানাচ্ছেন, “একই ফাইলের একই নোটশিটের সিদ্ধান্ত মোতাবেক আর এক আইপিএস অফিসার জ্ঞানবন্ত সিংহের বিরুদ্ধে কিন্তু বিভাগীয় তদন্ত হয়েছে। তাঁর পদোন্নতিও আটকেছে। কিন্তু ভিজিল্যান্স-ছাড়পত্র ছাড়াই প্রসূনবাবুকে পদোন্নতি দিয়ে দিল্লিতে পাঠানো হল কেন, তা জানা দরকার।” |
কী ধরনের তদন্ত হতে পারে?
মহাকরণের কর্তারা জানাচ্ছেন, স্বরাষ্ট্র দফতর আপাতত প্রশাসনিক ভাবে খতিয়ে দেখছে, ঘটনায় আর কোনও গাফিলতি ছিল কি না। তা শেষ হলে মুখ্যমন্ত্রীর চূড়ান্ত মতামত নেওয়া হবে। তার পরে প্রশাসনিক তদন্ত হবে, বা সিআইডি-কে তদন্তভার দেওয়া হতে পারে।
সরকারের এই উদ্যোগ প্রসঙ্গে সোমবার বুদ্ধদেববাবুর প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে তিনি মন্তব্য করতে চাননি। এ দিকে প্রশ্ন উঠছে, এত দিন বাদে অভিযুক্ত অফিসারদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব? তা ছাড়া মামলাটিও তো বিচারাধীন!
কিছু স্বরাষ্ট্র-কর্তার অভিমত, প্রসূনবাবু দু’বছর আগে অবসর নিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে এখন নতুন ভাবে কিছু করার সুযোগ কম। তবে রিজ-কাণ্ডের জেরে কেন তাঁকে তখন শাস্তি দেওয়া হল না, এর পিছনে অন্য অভিসন্ধি ছিল কি না, ভিজিল্যান্স ছাড়পত্র ছাড়া কী ভাবে ও কার মদতে তিনি পদোন্নতি পেয়ে দিল্লি চলে যেতে পেরেছিলেন এ সব যাচাই করা যেতেই পারে। আর এরই প্রেক্ষাপটে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে বলে প্রশাসনের এই মহলের দাবি। তাঁদের যুক্তি: বুদ্ধবাবুর হাতে স্বরাষ্ট্র দফতরের ভারও ছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ফাইলে তাঁর সই রয়েছে। “স্বাভাবিক ভাবেই ঘটনা পরম্পরায় তাঁর ভূমিকা প্রশ্নের মুখে।” মন্তব্য এক স্বরাষ্ট্র-কর্তার। প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সূত্রপাত হল কী ভাবে?
সরকারি সূত্রের খবর: রিজ-মামলা নিয়ে খোঁজ-খবর শুরু হতে দেখা যায়, বেশ কিছু ফাইল নিখোঁজ! আদালতের নির্দেশের পরে সরকারের গৃহীত ব্যবস্থাদি ও সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত সংক্রান্ত কিছু ফাইল বেপাত্তা। মহাকরণ-সূত্রের দাবি: স্বরাষ্ট্র-রেকর্ড অনুযায়ী অধিকাংশ ফাইল মুখ্যমন্ত্রীর অফিসে পাঠানো হয়েছিল। তার পরে উধাও হয়ে যায়। কর্তারা জানাচ্ছেন, ওই সময়ে স্বরাষ্ট্র দফতরে কর্মরত ছিলেন, এমন কিছু অফিসারের কাছে ফাইলের খোঁজ নেওয়া হলে তাঁদের এক জন ২০০৮-এর ২৪ সেপ্টেম্বর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর সই করা নোটশিট-সহ ফাইলের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ জোগাড় করে দেন। তাতেই নড়েচড়ে বসে স্বরাষ্ট্র দফতর। বুদ্ধদেববাবুর সই করা ওই নোটশিটই এখন সরকারের হাতিয়ার।
২০০৭-এর ২১ সেপ্টেম্বর রিজওয়ানুরের মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছিল। খুন না আত্মহত্যা তা নিয়ে বিতর্কের ঝড় ওঠে। শিল্পপতি অশোক তোদির মেয়ে প্রিয়ঙ্কাকে বিয়ে করেছিলেন রিজওয়ানুর। তাঁর পরিবারের অভিযোগ ছিল, কলকাতা পুলিশের কিছু বড় কর্তা রিজকে চাপ দিচ্ছিলেন বিয়ে ভাঙার জন্য। তাঁর মৃত্যু-রহস্য উদ্ঘাটনে সিবিআই-তদন্ত এবং দোষী পুলিশদের শাস্তি চেয়ে কলকাতা হাইকোর্টে যায় পরিবার। ১৬ অক্টোবর হাইকোর্ট সিবিআই-তদন্তের নির্দেশ দেয়। তার পরেই কলকাতার পুলিশ কমিশনার-সহ পাঁচ পুলিশ অফিসারকে পদচ্যুত করতে বাধ্য হয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার।
স্বরাষ্ট্র-কর্তারা জানিয়েছেন, ২০০৮-এর মাঝামাঝি নাগাদ সিবিআই তদন্ত-রিপোর্ট হাইকোর্টে পেশ করে, যাতে কলকাতা পুলিশের তৎকালীন গোয়েন্দা-প্রধান অজয় কুমার-সহ তিন অফিসারের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনা ও ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগে মামলা রুজুর অনুমতি চাওয়া হয়। পাশাপাশি তদানীন্তন পুলিশ কমিশনার প্রসূনবাবু এবং ডিসি (সদর) জ্ঞানবন্তের শাস্তির সুপারিশ করা হয়। কিন্তু মমতা-সরকারের অভিযোগ: তখনকার রাজ্য প্রশাসনের তরফে জ্ঞানবন্ত ও প্রসূন দু’জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও প্রসূনবাবুর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া তো হয়ইনি, উল্টে তিনি কেন্দ্রীয় পদে যোগ দিতে চাইলে ভিজিল্যান্স-ছাড়পত্র ছাড়াই তাঁকে রিলিজ দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে প্রসূনবাবুর এখন কী বক্তব্য?
প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার বলছেন, “এই প্রথম শুনলাম যে, আমার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তখন এক বছর আমাকে প্রোমোশন দেওয়া হয়নি। কিন্তু দিল্লি যাওয়ার ছাড়পত্র মঞ্জুরির সময়ে সরকার আমার পদোন্নতিতে সম্মতি জানিয়েছিল। অবসরের বছরে রাষ্ট্রপতির বিশেষ পদকও পেয়েছি।” প্রসূনবাবুর মতে, “রিজওয়ানুর কাণ্ডের প্রায় ছ’বছর হতে চলল। আমার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হলে চার বছরের মধ্যে নিতে হতো। এখন আর সরকার তা পারবে না।”
তাই কীসের জন্য এত দিন বাদে এ সব নিয়ে তৎপরতা শুরু হয়েছে, তা তাঁর বোধগম্য হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন প্রসূনবাবু। যদিও স্বরাষ্ট্র-সূত্রের দাবি: রিজ কাণ্ডে প্রসূনবাবুকে ‘রেহাই’ দেওয়ার প্রস্তাবে প্রশাসনিক কর্তারা সহমত না-হলেও তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর চাপে তা করতে হয়। একেই বড় ‘ব্যতিক্রম’ হিসেবে দেখছে মহাকরণ। স্বরাষ্ট্র-কর্তারা জানিয়েছেন, ভিজিল্যান্স-ছাড়পত্র বিনা কোনও অফিসারকে দিল্লিতে ছাড়া হয় না। “প্রায় একই সময়ে এক আইএএস অফিসারকে কলকাতা বন্দরের চেয়ারম্যান পদে যোগ দিতে দেওয়া হয়নি, কারণ তাঁর ভিজিল্যান্স-ক্লিয়ারেন্স ছিল না।” দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন এক অফিসার।
তা ছাড়া মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং যে ফাইলে সই করে প্রসূনবাবুর বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তের সুপারিশ করেছিলেন, তা কার্যকর হওয়ার বদলে ফাইলটাই কী ভাবে উধাও হয়ে গেল, সেটাও খতিয়ে দেখা একান্ত প্রয়োজন বলে মনে করছে স্বরাষ্ট্র দফতর।
|