ওঁদের কারও হাতে বালতি, তো কারও হাতে আম। কেউ আবার দু’টি পাতার ফাঁকে একটি কুঁড়ি নিয়েই নেমে পড়েছেন জোড়াফুলের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধে। ‘ধর্মযুদ্ধ’ই বটে। কেননা ওই তৃণমূল নেতাদের মতে, রাত-দিন এক করে লড়ে যাওয়া সত্ত্বেও তাঁদের পঞ্চায়েত ভোটের টিকিট না দিয়ে ঘোর ‘অধর্ম’ করেছে দল। তাই গোসা করে ওঁরা আপাতত ‘নির্দল’। জিততে না পারলেও নিজের নাক কেটে দলপতিদের যাত্রাভঙ্গ তো করা যাবে!
মঙ্গলবার বর্ধমান শহরে সভা করে এঁদের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে বর্ধমান জেলা সভাপতি (গ্রামীণ) স্বপন দেবনাথ। কিন্তু সর্ষের মধ্যেই যে ভূত! মন্তেশ্বরে ব্লক তৃণমূল সভাপতি দলীয় প্রার্থীদের প্রতীক জমা দেওয়ার আগেই পাঁচ জন অন্য গোষ্ঠীর কাছ থেকে প্রতীক জোগাড় করে এনে জমা দিয়ে বসে আছেন। এর মধ্যে গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রার্থীরা যেমন আছেন, পঞ্চায়েত সমিতির প্রার্থীও আছেন। জোড়াফুল তাঁদের পকেটে। অতএব, ওই পাঁচ আসনে দলের আসল প্রার্থীদেরই লড়তে হচ্ছে ‘নির্দল’ হয়ে।
তৃণমূলের জেলা নেতাদের দাবি, গ্রাম পঞ্চায়েত এবং পঞ্চায়েত সমিতিতে কারা প্রার্থী হবেন, নিচুতলার নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেই তা স্থির করা হয়েছিল। কিন্তু গোড়া থেকেই মন্তেশ্বরে নানা দ্বন্দ্ব ছিল। পঞ্চায়েতের তিনটি স্তরেই বেশ কিছু আসনে একের বেশি মনোনয়ন জমা পড়ে। সে সময়ে গণ্ডগোল এড়াতে ব্লক নেতারা বিরোধিতার রাস্তায় হাঁটেননি। শেষ মুহূর্তে তৃণমূলের তরফে এক আসনে এক জনই প্রার্থী রাখার ব্যাপারে মরিয়া চেষ্টা করা হয়। জেলা পরিষদের অতিরিক্ত প্রার্থীরা তাঁদের মনোনয়ন তুলে নিলেও গ্রাম পঞ্চায়েত এবং পঞ্চায়েত সমিতির বহু আসনেই তা হয়নি। মন্তেশ্বর পঞ্চায়েত সমিতির আসনসংখ্যা ৩৬, গ্রাম পঞ্চায়েতের আসন ১৭৬টি। বাঘাসন, শুশুনিয়া, মন্তেশ্বর, পিপলন, দেনুড়, বামুনপাড়া, মাঝেরগ্রাম এই সাতটি পঞ্চায়েতে একটি করে পঞ্চায়েত সমিতির আসনে রয়েছে তৃণমূলের ‘গোঁজ’ প্রার্থী। পঞ্চায়েতের আসনগুলিতে নির্দল প্রার্থীর সংখ্যা ২৫। এর অধিকাংশই গোঁজ।
মন্তেশ্বর পঞ্চায়েত সমিতির বিরোধী দলনেতা দেবব্রত রায় এ বার বাঘাসন পঞ্চায়েত এলাকার একটি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। কিন্তু তাঁর দাঁড়ানো মেনে নিতে পারেননি বাঘাসন পঞ্চায়েতের বিরোধী দলনেতা প্রসন্ন মণ্ডল। ‘জোড়া পাতা একটি কুঁড়ি’ নিয়ে তিনি নেমেছেন লড়াইয়ে। তাঁর কথায়, “আমি দশ বছর ধরে এই পঞ্চায়েত এলাকার বিরোধী দলনেতা। এ বার ব্লক নেতারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, প্রার্থী করবেন। শেষ মুহূর্তে দেখা গেল, মন্তেশ্বর থেকে দেবব্রতবাবু প্রার্থী হয়ে গেলেন। এটা মেনে নিতে পারিনি।” মাঝেরগ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার একটি আসন থেকে পঞ্চায়েত সমিতিতে প্রার্থী হয়েছেন লালন শেখ। তাঁর বিরুদ্ধে আবার দাঁড়িয়ে পড়েছেন এলাকার প্রভাবশালী নেতা অধীর পাল। বামুনপাড়া পঞ্চায়েতেও তৃণমূল প্রার্থী নিয়ামউদ্দিন মণ্ডলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন ওই এলাকারই দলীয় নেতা জীবন মণ্ডল।
বেশ কয়েকটি আসনে গোঁজ প্রার্থীর দাঁড়িয়ে পড়ার বিষয়টি স্বীকার করে তৃণমূলের ব্লক সভাপতি সজল পাঁজা বলেন, “দুর্ভাগ্যজনক হলেও ঘটনাটি ঘটেছে। এখন তো আর ওঁদের প্রার্থিপদ প্রত্যাহার করানো সম্ভব নয়। তাই লিফলেট বিলি করে দলের টিকিটে দাঁড়ানো প্রার্থীদের সমর্থন করার জন্য গোঁজ প্রার্থীদের বলা হচ্ছে।” চালু নিয়ম অনুযায়ী, পঞ্চায়েত এবং পঞ্চায়েত সমিতির দলের টিকিট পাওয়া প্রার্থীদের প্রতীক জমা দেওয়ার কথা ব্লক সভাপতির। অথচ সজলবাবুর দাবি, “কী করে অন্য কিছু লোক প্রতীক জমা দিল, তা আমারও বোধগম্য হয়নি। দলের সর্বভারতীয় সভাপতি মুকুল রায় এবং জেলা সভাপতি স্বপন দেবনাথের উপরেই বিচারের ভার ছেড়ে দিয়েছি।”
স্বপনবাবুর দাবি, কী করে এমনটা ঘটল তা তাঁরও জানা নেই। এ দিন তিনি বলেন, “মন্তেশ্বরে এমন হয়েছে শুনেছি। এ নিয়ে তদন্ত হবে।” সেই সঙ্গে তাঁর সংযোজন, “শুধু মন্তেশ্বর নয়। জেলার যেখানেই দলীয় গোঁজ রয়েছে, তাঁদের লিফলেট বিলি করে দলীয় প্রার্থীকে সমর্থন জানাতে বলা হয়েছে। এতে কাজ না হলে দল কড়া হবে।” |