উজ্জ্বল ছবি অচেনা মুখ
মাসের পয়লা তারিখ। হাতে ফর্দ ঝুলিয়ে আপনি ঢুকলেন শহরের কোনও বড় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাজারে। এটা, ওটা, সেটা দেখার পর হঠাৎই অভিনব আবিষ্কার, আপনার নিত্য পরিচিত ডিটারজেন্ট এ বার ২৫ শতাংশ ‘এক্সট্রা’। সঙ্গে সঙ্গে বড়সড় হাসি আপনার ঠোঁটে।
হালফিলের জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনী স্লোগানও বলছে ‘এক্সট্রা’ পেলে সব সময়ই দিল খুশ।
কথাটা হয়তো পরিচালকদের ক্ষেত্রেও ষোলো আনা খাঁটি। কী ভাবে? এই যেমন ধরুন চিত্রনাট্যের খাতিরে তৈরি করতে হবে জনতার দৃশ্য। কিংবা নায়কের চরিত্র জোরদার করতে দরকার ছিঁচকে গুন্ডার। বা নায়িকার সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে নাচার জন্য প্রয়োজন পড়ল নর্তকীদের। পরিচালকদের এমন সব নানা প্রয়োজনে মুশকিল আসান হিসেবে যাঁরা পর্দায় আসেন, ইন্ডাস্ট্রির ভাষায় তাঁরাই ‘এক্সট্রা’। অর্থাৎ এঁরা নিজেরা ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকেন। বেশির ভাগ সময়েই নির্বাক, কখনও সখনও বা সবাক উপস্থিতিতে ফোরগ্রাউন্ডের অভিনেতাদের জোরালো করে তুলতে। তাই জুতসই ‘এক্সট্রা’ পেলে সময়ে অসময়ে পরিচালকদের দিল খুশ হয় বইকী।
সময়ের বদলে অবশ্য বদলেছে এঁদের পরিচিতি। তাই এঁরা এখন ‘জুনিয়র আর্টিস্ট।’ কিন্তু প্রশ্নটা ওই ‘নাম মে ক্যয়া রাখ্খা হ্যায়?’ পরিচিতি বদলানোয় তাঁদের পরিস্থিতি বদলেছে কি? বেশি দূরে নয়, আমাদের নিজেদের টলিউডের এক্সট্রারাই বা কেমন আছেন এখন?

পাল্টে যাওয়াই দরকার
কয়েক বছর আগের কথা। সারা দিন শ্যুটিংয়ের ধকল নেওয়ার পরে যে পরিমাণ পারিশ্রমিক পেতেন জুনিয়র আর্টিস্টরা, তা দিয়ে দিন গুজরানই অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। আবার পরিচালক-প্রযোজক ভেদে হেরফের হত পারিশ্রমিকের অঙ্কও।
গত পাঁচ ছ’বছরে আর্থিক ছবিটা কিছুটা বদলালেও পরিস্থিতি কিন্তু মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। কেন? আসুন তবে আরও একটু তলিয়ে দেখা যাক ব্যাপারটা।
যে কোনও ছবিতে জুনিয়র আর্টিস্টদের প্রধান সরবরাহকারী হিসেবে বেশ কয়েকটি ‘এজেন্সি’ কো-অর্ডিনেটর সংস্থা হিসেবে অনেক বছর ধরেই রমরমিয়ে রাজত্ব করছে। আবার কোনও প্রভাবশালী ব্যক্তিও অনেক সময় এই ধরনের কো-অর্ডিনেটরের কাজ করেন। এঁদের মূল কাজ হল এক্সট্রাদের প্রাপ্য পারিশ্রমিক নির্ধারণ করা। পরোক্ষে ‘সার্ভিস চার্জ’ বাবদ নিজেদের কমিশনটা বুঝে নেওয়া। এবং সমস্যাটা এখানেই। কী রকম?

‘ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি’ ছবিতে মাধুরী আর রণবীরের নাচের দৃশ্য
কি জমত পেছনে ‘এক্সট্রা’ নৃত্যশিল্পীদের উদ্দাম নাচের বিভঙ্গ ছাড়া
তাঁরা বলেন
অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষ জানালেন, ইন্ডাস্ট্রিতে যত সংখ্যক জুনিয়র আর্টিস্ট রয়েছেন, তাদের একাংশ শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসেবেই বেছে নিয়েছেন এই পেশাকে। অভিনয়ের প্রতি তাঁদের তাগিদটা তাই অনেকটাই ‘মানি-ডিপেনডেন্ট’। কিন্তু বাকিরা এসেছেন শুধুমাত্র অভিনয়ের টানে। “কিন্তু অদ্ভুত এক জাঁতাকলে পড়ে তাঁদের পুরো জীবনটাই এক্সট্রা হিসেবে কেটে যায়।”, বলছেন রুদ্রনীল।
আসলে বিভিন্ন এজেন্সি যারা এঁদের ক্যামেরার সামনে আসার প্রথম সুযোগ দেয়, তারাই নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য নানা রকম যুক্তির জাল বোনে। জুনিয়র আর্টিস্টদের বোঝায়, এজেন্সির সূত্র ছাড়া, স্বাধীন ভাবে কোনও ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পেলে এঁরা যেন না নেন। কারণ সেখানে প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ভয়ে এজেন্সির চৌহদ্দির বাইরে পা বাড়ান না এঁরা। ফলে সারা জীবন কেটে যায় ওই এক্সট্রা হিসেবেই। অবশ্য যদি না তার আগেই কেউ ইন্ডাস্ট্রি ত্যাগ করে।
এ প্রসঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন রুদ্রনীল। বললেন, “সম্প্রতি একটি ছেলের সঙ্গে আলাপ হল। সুদর্শন, চোখে-মুখে বুদ্ধির ছাপ। তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম বাংলায় এম.এ করেছে সে। তবে গত তিন বছর ধরে ওই জুনিয়র আর্টিস্ট তকমাতেই কাজ করে যাচ্ছে। আর রুজির উৎস বলতে দু একটা টিউশন।” এবং পুরোটাই ওই এজেন্সির জাঁতাকল, মত রুদ্রনীলের।

নিজেদের বয়ানে
এমনটা পুরোপুরি অবশ্য মানতে নারাজ জিৎ সেনগুপ্ত। একটি জনপ্রিয় বাংলা মেগা ধারাবাহিকের জুনিয়র আর্টিস্ট জিৎ। জানালেন, কো-অর্ডিনেটরের মাধ্যমে অভিনয়ের আর্জি জানালে যদি বা সুযোগ মেলে, স্বাধীন উদ্যোগে তার সিকিভাগ সুযোগও আসে না। উল্টে আবেদনের পোর্টফোলিও স্থান পায় ডাস্টবিনে। তারকাদের উপরও কম ক্ষুব্ধ নন এই বছর পঁচিশের তরুণ। তাঁর মতে, “টলিউডের কোনও সেলিব্রিটিই আসলে আমাদের মতো জুনিয়র আর্টিস্টদের নিয়ে ভাবেন না।” ক্ষোভ রয়েছে পারিশ্রমিক নিয়েও। কেন? জিৎ জানালেন, বারো ঘণ্টা টানা শ্যুটিং করলেও দৈনিক পারিশ্রমিক কিন্তু সেই ১০০-১২০ টাকা। অন্তত ধারাবাহিকের দুনিয়ার ছবিটা এরকমই।
বছর সত্তরের সত্যব্রত মুখোপাধ্যায়ের ক্ষোভটা আবার অন্যত্র। জানালেন, অনেক সময়ই ভদ্র ব্যবহারটুকু পান না তাঁরা। যেমন কয়েক দিন আগেই একটি শ্যুটিংয়ের অভিজ্ঞতা জানালেন তিনি। লাঞ্চটাইম। নিজেদের খাবারের প্যাকেটটি নিতে লাইন দিয়েছেন অন্তত পাঁচশো জুনিয়র আর্টিস্ট। তাঁদের উদ্দেশে তত্ত্বাবধায়কের উক্তি, “খেতে হলে খা, না হলে যা।” বলতে বলতে চোখ ভিজে ওঠে সত্যব্রতবাবুর। আরও জানালেন, শ্যুটিং করতে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তাঁদের। মহিলা, কিংবা প্রৌঢ় কারও জন্যই কোনও বিশ্রামের জায়গা নেই। তবে সত্যব্রতবাবুর দাবি, পরিচালক কিংবা তারকাদের কাছ থেকে কখনও তাচ্ছিল্য বা অবজ্ঞা পাননি তিনি। আশার কথা ওটুকুই।
একমত কৃষ্ণ সরকারেরও। লেখাপড়ার পাঠ শেষ হওয়ার আগেই অভিনয় জগতে ঢুকে গিয়েছেন কৃষ্ণ। এখন আপাতত জুনিয়র আর্টিস্ট হিসেবেই কাজ মিলছে। তবে তাঁর আশা, কোনও না কোনও দিন মিলবে পুরোদস্তুর অভিনেতা হওয়ার সুযোগও। সেই ভরসাতেই বললেন তিনি, “হোক না পারিশ্রমিক কম, জুনিয়র আর্টিস্ট হিসেবে অন্তত ক্যামেরার সামনে অভিনয়ের প্রথম সুযোগটা তো দেয় টলিউড। হাতেখড়ি হিসেব তা-ই বা কম কী!”
প্রথমে এক্সট্রা পরে সুপারস্টার

মুমতাজ

সিলভেস্টার স্ট্যালোন

জ্যাকি চ্যান

মেরিলিন মনরো
‘এক্সট্রা’ ছবি
এ কথা সত্যি ইন্ডাস্ট্রির নিজস্ব সমীকরণে আজও পিছনের সারির অভিনেতা জুনিয়র আর্টিস্টরা। তাঁদের জীবনের গল্প কিন্তু রুপোলি পরদায় সুপারডুপার হিট। এক বার নয়, বার বার। উদাহরণ? ‘রঙ্গিলা’ ছবির মিলিকে (উর্মিলা মাতণ্ডকর) মনে আছে তো? নায়িকা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর মিলি অভিনয় জগতে এসেছিল কিন্তু ফিল্মের জুনিয়র আর্টিস্ট হিসেবেই।
যদি মিলিকে ভুলেও গিয়ে থাকেন, কুছ পরোয়া নেহি। ঝপ করে চলে আসুন ২০০৭ সালে। চোখের সামনে ভেসে উঠবে ‘ওম শান্তি ওম’-এর কাহিনি। পুরো গল্পটাই এক জুনিয়র আর্টিস্ট পরিবারের। ওমপ্রকাশ মাখিজা (শাহরুখ খান) সেই পরিবারেরই ছেলে। উত্তরাধিকার সূত্রে ‘হিরো’ হওয়ার স্বপ্ন যাঁর চোখে। মনে করে দেখুন, মদ্যপ অবস্থায় যখন নিজের ‘ফিল্মফেয়ার’ ট্রফি হাতে ‘ভিকট্রি স্পিচ’ দিচ্ছে ওমি। সবটাই তাঁর ভ্রম। কিংবা এক বার ফ্ল্যাশব্যাকে দেখে নিন ‘শুকনো লঙ্কা’-র চিনু নন্দীকে। শেষ বয়সে ‘নায়ক’ হওয়ার সুযোগ মিললেও তাঁর সারা জীবন কিন্তু কেটে যায় ওই ‘এক্সট্রা’ হয়েই। আসলে ওমি, মিলি কিংবা চিনু নন্দীর এই তাগিদটা যে ষোলো আনার উপর আঠারো আনা বাস্তব। বিশ্বাস না হলে আশপাশের পরিচিত ‘জুনিয়র আর্টিস্টদের’ জিজ্ঞাসা করে দেখুন। আজও ওঁরা প্রথম ‘ব্রেকের’ অপেক্ষায়।

পিকচার অভি বাকি হ্যায়
আশাবাদীদের অবশ্য পরামর্শ, মন খারাপ করলে একটু গুগল সার্চ করে নিন। নয় নয় করে অন্তত উনিশ জন হলিউড স্টারের নাম বেরিয়ে আসবে আপনার সামনে যাঁরা কখনও না কখনও ‘এক্সট্রা’ হিসেবেই শুরু করেছিলেন নিজেদের অভিনয়-জীবন। বিশ্বাস হচ্ছে না। তবে একটু পরিশ্রম করুন। ১৯৪৮ সালের ‘স্কুড্ডা হু! স্কুড্ডা হে’ ছবির প্রিন্ট যদি পান, চালিয়ে দেখবেন, কী ভাবে সর্বকালের অন্যতম সেরা এক লাস্যময়ী অভিনেত্রীকে মাত্র দু’টি শব্দ আওড়ানোর সুযোগ দিয়েছিল এই ছবি। অভিনেত্রীর নাম? মেরিলিন মনরো।
ব্রুস লি-র ‘ফিস্টস অব ফিউরি’(১৯৭১) এবং ‘এন্টার দা ড্র্যাগন’(১৯৭৩) ছবিতে জুনিয়র আর্টিস্ট ছিলেন স্বয়ং জ্যাকি চ্যান। এমনকী, সদ্য সেরা ছবির পুরস্কার নিতে অস্কার মঞ্চে ওঠা বেন অ্যাফ্লেকেরও পর্দায় আসা ‘এক্সট্রা’ হিসেবেই। তালিকাটা এখানে শেষ নয়। সিলভেস্টার স্ট্যালোন, ক্লিন্ট ইস্টউড থেকে শুরু করে ব্র্যাড পিট, হলিউডের তাবড় অভিনেতারা কিন্তু ফিল্মের টাইটেল কার্ডে কখনও না কখনও জুনিয়র আর্টিস্ট তকমা পেয়েছেনই।
এ বার যদি হলিউড থেকে জুম আউট করে বলিউডের ক্লোজ আপ নেন, দেখবেন ষাট-সত্তর দশকের অন্যতম সেরা এক অভিনেত্রীর কর্মজীবন শুরু হচ্ছে এক্সট্রা হিসেবে। এর পরে অবশ্য দারা সিংহের নায়িকা হিসেবে বেশ কয়েকটা ছবি করায় তাঁর নামের আগে বসে গিয়েছিল ‘স্টান্ট ফিল্ম হিরোইন’-এর খেতাব। কিন্তু ১৯৬৫ সালে যখন ‘মেরে সনম’ ছবির ‘ইয়ে হ্যায় রেশমি জুলফো কা অন্ধেরা’ গানটিতে দর্শকরা মুমতাজকে দেখেন, ঠিক সেই মুহূর্তেই ধূসর হয়ে যায় তাঁর পূর্ব পরিচিতি। ১৯৭০-এ ‘খিলোনা’ ছবির জন্য ফিল্মফেয়ারে পান সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কারও।
পুরোটাই অবিশ্বাস্য। কিংবা বিরল। এক্সট্রা থেকে পুরোদস্তুর অভিনেতা হয়ে ওঠার এই পুরো পথটাই যে ভীষণ বন্ধুর, এ কথা মানছেন অনেকেই। কিন্তু ফোরগ্রাউন্ডে আসার, স্পটলাইট পাওয়ার তাগিদটা যে সব কিছু ছাপিয়ে যায়। আর তাই বোধহয় এই বিরল নজিরগুলিতে ভরসা রেখে ‘এক্সট্রা’রা আজও বলতে পারেন, ‘পিকচার অভি বাকি হ্যায়।’



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.