পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রচারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য বুলেট প্রুফ গাড়ির বন্দোবস্ত করেছে রাজ্য প্রশাসন। নিরাপত্তার খাতিরে তাঁকে অনেক দিন ধরে ওই গাড়ি ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হলেও তা কানে তোলেননি তিনি। শেষে মহাকরণের কর্তাদের এক রকম ঝুলোঝুলিতেই মমতা বুলেট প্রুফ গাড়িতে চাপতে নিমরাজি হয়েছেন বলে প্রশাসন সূত্রের খবর। আর তাঁদের কথা শুনে যদি তিনি ওই গাড়িতে চড়েন, তা হলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন পুলিশকর্তারা।
বর্তমানে পুলিশের ভাঁড়ারে গোটা দশেক বুলেট প্রুফ গাড়ি থাকলেও সেগুলির অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। তাই মমতার দিক থেকে ইতিবাচক ইঙ্গিত পাওয়ার পরেই তাঁর জন্য দু’টো বুলেট-রোধী (বুলেট প্রুফ বা বিপি) এসইউভি গাড়ি কিনেছে রাজ্য সরকার। এমনকী, তাঁর জেলা সফরে কনভয়ের আগে ‘পাইলট কার’ রাখার কথাও ভেবেছেন পুলিশকর্তারা। মহাকরণের এক কর্তা বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তার কথা ভেবে কিছু দিন ধরেই তাঁকে বিপি গাড়ি নেওয়ার আর্জি জানানো হচ্ছিল। কিন্তু তিনি রাজি হচ্ছিলেন না। সম্প্রতি ছত্তীসগঢ়ে কংগ্রেস নেতাদের উপরে মাওবাদী হামলার পরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও তাঁর নিরাপত্তা আঁটোসাটো করতে নির্দেশ পাঠিয়েছে। অনেক অনুরোধ-উপরোধের পরে অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীকে কিছুটা রাজি করানো গিয়েছে।”
বিরোধী নেত্রী থাকাকালীনই মমতাকে ‘জেড প্লাস’ মানের নিরাপত্তা দেয় তৎকালীন বাম সরকার। সেই কারণে তখন থেকেই তাঁকে বুলেট প্রুফ গাড়ি ও অতিরিক্ত দেহরক্ষী নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে কেন্দ্রও বারেবারে সতর্কবার্তা পাঠায়। এবং তাঁর জন্য উপযুক্ত সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দেয় রাজ্য সরকারকে। কিন্তু বাম প্রশাসনের কোনও সুপারিশই না মানায় এক সময় মমতার নিরাপত্তার ভার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের হাতে সঁপে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন রাজ্যের পুলিশকর্তারা। তাঁদের যুক্তি ছিল, মমতা যখন পুলিশের কথা শোনেন না, তখন তাঁর নিরাপত্তার দায় কেন সরকার নিজের ঘাড়ে নেবে? কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক কখনওই ওই বক্তব্যকে আমল দেয়নি। উল্টে জানিয়ে দেয়, রাজ্যকেই এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।
এই বিতর্কই চরমে পৌঁছয় ২০১০-এ। মমতা তখন রেলমন্ত্রী। এবং সেই সুবাদেই তাঁকে নিরাপত্তা দিত রেলরক্ষী বাহিনী (আরপিএফ)। ওই আরপিএফ-কেই লালগড় সফরে রাস্তার দু’ধারে ডিউটি করতে দেখে রাজ্য পুলিশের তরফে চিঠি লিখে নালিশ জানানো হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে। বলা হয়, রাজ্যকে অন্ধকারে রেখেই লালগড়ে আরপিএফ নিয়ে গিয়েছেন রেলমন্ত্রী। অভিযোগ করা হয়, তিনি নিরাপত্তা ব্যবস্থার খুঁটিনাটি মানেন না। দু’জন করে দেহরক্ষী দেওয়া হলেও অধিকাংশ সময়ে তাঁদের গাড়িতে নেন না। কোথায় যাবেন, তা-ও আগে জানানো হয় না। রাজ্য পুলিশের আরও অভিযোগ ছিল, ‘জেড প্লাস’ মানের নিরাপত্তা সত্ত্বেও মমতা অধিকাংশ সময়ে বুলেট প্রুফ গাড়িতে চড়েন না। কনভয়ে দলীয় নেতানেত্রীদের এত গাড়ি থাকে যে, তার নিয়ন্ত্রণ পুলিশের হাতে থাকে না। কিন্তু তার পরেও মমতার নিরাপত্তা সংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যার সমাধানসূত্র রাজ্যকেই খুঁজে নিতে বলে কেন্দ্র। বিতর্কে ইতি টানতে তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম নিজেই চিঠি লেখেন তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে।
এই পরিস্থিতিতে বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়। ২০১১-তে রাজ্যে পালাবদলের পরে মুখ্যমন্ত্রী হন মমতা। কিন্তু নিরাপত্তার ঘেরাটোপ কোনও দিনই পছন্দ করতেন না বলে এর পরেও পুলিশ নিয়ে বিশেষ একটা ঘোরাফেরা করতে দেখা যায় না তাঁকে। এমনকী, সেই পুরনো গাড়িই বহাল রাখেন তিনি। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “তাঁর পছন্দ-অপছন্দ জানতাম বলে প্রথম দিকে আমরাও কিছু বলিনি। কিন্তু রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশের (আইবি) কিছু রিপোর্টের প্রেক্ষিতে না বলে উপায় ছিল না।”
কী আছে আইবি-র সেই রিপোর্ট? মহাকরণ সূত্রের খবর, আইবি জানিয়েছে, বছরখানেক অন্য রাজ্যে ঘাপটি মেরে থাকার পরে সংখ্যায় কম হলেও মাওবাদীরা ফিরে এসেছে জঙ্গলমহলে। তাদের গতিবিধিরও খবর আসছে। মাওবাদীরা যে গ্রামে ঘুরে মিটিং করছে, লেভি আদায়ের চেষ্টা করছে এবং পঞ্চায়েত ভোটে দাঁড়ালে ‘ফল ভাল হবে না’ বলে নয়াগ্রামের তৃণমূল নেতাদের হুমকি দিচ্ছে, তা-ও মহাকরণকে জানিয়েছে আইবি। এ ছাড়াও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সূত্রে বলা হচ্ছে, ছত্তীসগঢ় থেকে মাওবাদী নেতারাও পশ্চিমবঙ্গে আসতে চাইছেন। ওই রাজ্য থেকে পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত একটি করিডর তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। এই রাজ্যের শীর্ষ নেতাদের নিশানা করা হতে পারে বলেও গোয়েন্দাদের কাছে খবর। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনী প্রচারে জেলা সফরে বেরোবেন মুখ্যমন্ত্রী। তার আগে বিন্দুমাত্র ঝুঁকি নিতে চাইছেন না রাজ্য প্রশাসনের কর্তারা। গাড়ি থেকে আচমকা নেমে মানুষের ভিড়ে ঢুকে পড়ার অভ্যাস এখনও রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর। প্রশাসনিক কর্তারা মনে করছেন, মাওবাদীরা এই পরিস্থিতির ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করতেই পারে।
তাই মমতার জন্য বুলেট প্রুফ গাড়ি ছাড়াও তাঁর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢেলে সাজতে চাইছে সরকার। এক পুলিশকর্তা বলেন, “বর্তমানে আইবি-র স্পেশ্যাল সিকিওরিটি ইউনিট (এসএসইউ)-ই মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্ব সামলায়। তাঁদের মাথায় রয়েছেন এডিজি পদমর্যাদার অফিসার, নিরাপত্তা অধিকর্তা বীরেন্দ্র। মহাকরণের কর্তারা ঠিক করেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা যথাযথ ভাবে ঢেলে সাজতে আইজি পদমর্যাদার আরও এক জনকে ওই দায়িত্ব দেওয়া হবে।” কে ওই দায়িত্ব পাবেন, তা চূড়ান্ত না হলেও প্রশাসন সূত্রের খবর, রাজ্যে সদ্যগঠিত দুর্নীতি দমন শাখার আইজি রামফল পওয়ারের দিকেই পাল্লা ভারী। কেন?
মহাকরণের কর্তাদের বক্তব্য, এই রাজ্যের ক্যাডার হলেও রামফল ডেপুটেশনে টানা সাত বছর স্পেশ্যাল প্রোটেকশন গ্রুপ বা এসপিজি-তে ছিলেন। যে হেতু ওই সংস্থার কম্যান্ডোরা প্রধানমন্ত্রী ও গাঁধী পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তায় নিযুক্ত, তাই রাজ্য প্রশাসনও ওই আইপিএস অফিসারের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চাইছে। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে বীরেন্দ্রর পাশাপাশি রামফলের হাতেই মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্ব ন্যস্ত করবে মহাকরণ। |