জঙ্গলমহলে দাঁড়িয়ে তাদের সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানানোর পরে মাওবাদীরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরে প্রাণঘাতী হামলা চালাতে পারে বলে আশঙ্কা করছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
গোয়েন্দা সূত্রে খবর এসেছে, মমতা যে ভাবে মাওবাদীদের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন, তাতে মাওবাদী সংগঠনের একটা অংশ তাঁর উপর আঘাত হানতে চাইছে। এই অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা আরও বাড়াতে চাইছে কেন্দ্র। নিরাপত্তার দায়িত্ব ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ড (এনএসজি)-র ব্ল্যাক ক্যাট কম্যান্ডোদের হাতে দিতে চাইছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। এ বিষয়ে রাজ্য সরকারকে জানানোও হয়েছে। গোয়েন্দা বাহিনীর রিপোর্ট অনুযায়ী, মাওবাদীদের একটা অংশ স্থানীয় সিপিএম কর্মীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। মমতার উপরে হামলা চালানোর ষড়যন্ত্রে সিপিএমের ওই সব স্থানীয় কর্মীরাও সাহায্য করছে।
কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। মমতা রেলমন্ত্রী হিসেবে যেমন কোনও নিরাপত্তা নিতেন না, মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরও তাঁর সেই মনোভাব পাল্টায়নি। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার মুখ্যমন্ত্রীর জন্য জেড-প্লাস নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রয়োজন বলে ঠিক করেছে। কনভয়ে পাইলট কারের পাশাপাশি একাধিক গাড়ি থাকা জরুরি। কারণ কোনও কারণে মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ি খারাপ হয়ে গেলে বা বিস্ফোরণ ঘটানো হলে কনভয়ের অন্য গাড়িতে চাপিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু সমস্যা মমতাকে নিয়েই। তিনি জেড-প্লাস নিরাপত্তার মাপকাঠি অনুযায়ী ‘বুলেটপ্রুফ’ গাড়িতে চড়েন না। মানতে চান না অনেক নিয়মই। |
নিরাপত্তা-বলয় ভেঙে এ ভাবেই বারবার জনতা পৌঁছে যায় মুখ্যমন্ত্রীর ধারেকাছে। বুধবার বারাসতের ছবি। |
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক চাইছে, মুখ্যমন্ত্রীর হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাসভবনেও নিরাপত্তা বাড়ানো হোক। মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িমুখো সমস্ত গাড়ি, বিশেষ করে মোটরবাইকের উপর নজর রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সাদা পোশাকের গোয়েন্দাদের। বাড়ির পিছনের রাস্তাতেও নজর রাখা হচ্ছে। মাওবাদীদের প্রকাশ্য সংগঠনের সদস্যরা মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে বিক্ষোভ দেখাতে পারে বা গণ্ডগোল পাকানোর চেষ্টা করতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে। মমতা দিল্লিতে এলেও তাঁর জন্য বিশেষ নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করতে চায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
মাওবাদীরা বড়সড় হামলা চালাতে পারে বলে এর আগে একাধিক বার পশ্চিমবঙ্গ-সহ বিভিন্ন রাজ্যকে সতর্ক করেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। এখন তারা চাইছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ বার থেকে ভিভিআইপিদের নিরাপত্তার নিয়ম মেনে চলুন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক চাইছে, মুখ্যমন্ত্রীর কনভয়ে একটি পাইলট কারের সঙ্গে জ্যামার থাকুক। এক মাত্র গত সপ্তাহে জঙ্গলমহল সফরের সময়ই মুখ্যমন্ত্রীর কনভয়ের সামনে দু’টি বিশেষ পাইলট কার, জ্যামার ও একাধিক পুলিশের গাড়ি ছিল।
নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি কোনও দিনই পছন্দ করেন না মমতা। তিনি চান না, তাঁর গাড়ির সামনে পুলিশের পাইলট কার থাকুক। কলকাতায় হোক বা জেলা সফরে, সব সময়ই গাড়ির সামনের আসনে চালকের পাশে বসেন তিনি। বাড়ি থেকে মহাকরণ যাওয়ার পথে যখন-তখন গাড়ি থামিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন। গাড়ির কাঁচ নামিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথাও বলেন। কখনও মহাকরণের কিছু আগেই রাস্তায় নেমে হাঁটতে শুরু করেন। সে সময়ও অনেকে তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার চেষ্টা করেন। নিরাপত্তা নিয়ে বহু বার সতর্ক করা সত্ত্বেও মমতা পুলিশ-গোয়েন্দাদের অনুরোধ কানে তোলেননি। মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা বলয়ে যে কত বড় ফাঁকফোকর রয়েছে, গত কাল বারাসতে তার ফের প্রমাণ মিলেছে। অন্য কোনও রাজ্যে জনতার সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে মুখ্যমন্ত্রীর হাতের ঘড়ি হারিয়ে যাচ্ছে, এমনটা কল্পনার অতীত।
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে রেলমন্ত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিরাপত্তা দায়িত্বে থাকত আরপিএফ। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরও অগস্ট মাসের শেষ পর্যন্ত আরপিএফ-ই মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল। তবে মূল নিরাপত্তা বলয়ের বাইরে রাজ্য পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের কর্মীরা মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় ঘিরে রাখতেন। আরপিএফের ৭৫ জন কর্মীর উপরেই মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তার ছিল। এখন ওই কর্মীদের অধিকাংশকেই আরপিএফ-এ ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত পুলিশ-গোয়েন্দারা। গত কয়েক মাসে একাধিক বার মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে সমস্যায় পড়েছেন তাঁরা। মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে কলকাতা পুলিশও চিন্তিত। কারণ কলকাতার রাস্তায় যখন তিনি চলাফেরা করেন, তখনও পুলিশের কনভয় তাঁর পিছন পিছন ছুটুক, তা মুখ্যমন্ত্রীর পছন্দ নয়। একই ভাবে মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ের বাইরে উর্দিধারী পুলিশ থাকুক, তা তিনি চান না। সেখানেও তাই সাদা পোশাকের পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
গত সপ্তাহে জঙ্গলমহলে গিয়ে মাওবাদীদের হিংসা থামাতে সাত দিনের সময়সীমা দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। মাওবাদীদের থেকে ইতিবাচক সাড়া না পেলে তিনি যে ফের যৌথ অভিযান শুরু করতে চান, তা-ও বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। এ জন্য কেন্দ্রের কাছে বাড়তি বাহিনীও চেয়েছেন। অথচ তার মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রীর কড়া সমালোচনার পাশাপাশি রাজ্য সরকারকে হুমকি দিয়ে জঙ্গলমহলে লিফলেট ছড়িয়েছে মাওবাদীরা। এই পরিস্থিতিতে গোয়েন্দারা মনে করছেন, মুখ্যমন্ত্রীর উপরে প্রাণঘাতী হামলার আশঙ্কা বেড়ে গিয়েছে। শনিবার দিল্লিতে জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের বৈঠকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরমের সঙ্গে মমতার বৈঠক হবে। সেখানেও এ নিয়ে আলোচনা হবে।
২০০৮-এর নভেম্বরে শালবনিতে জিন্দালদের ইস্পাত প্রকল্পের শিলান্যাস অনুষ্ঠান থেকে ফেরার সময় খোদ মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কনভয়ে মাইন-বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল মাওবাদীরা। মুখ্যমন্ত্রী অল্পের জন্য বেঁচে যান। সেই ঘটনার সূত্র ধরেই জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের সক্রিয় উপস্থিতি প্রকাশ্যে আসে। ওই ঘটনার পরে প্রায় আড়াই বছর ধরে ওই এলাকার বহু সিপিএম নেতা-কর্মীকে মাওবাদীরা খুন করেছে। পালাবদলের পরে গত পাঁচ মাসে ওই এলাকায় জনা কয়েক তৃণমূল নেতাকে খুন করেছে মাওবাদীরা। গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী, মমতার সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই জঙ্গলমহলে মাওবাদী দমন অভিযান বন্ধ আছে। কিন্তু ছত্তীসগঢ়-সহ অন্য মাওবাদী অধ্যুষিুত রাজ্যে নিয়মমাফিক অভিযান চলছে। এই অবস্থায় মাওবাদীদের অন্ধ্র ও ছত্তিসগঢ় শাখার অ্যাকশন স্কোয়াডের বেশ কিছু সদস্য ওই সব রাজ্যে তাড়া খেয়ে আপাতত ‘নিরাপদ’ জঙ্গলমহলে গা ঢাকা দিয়েছে। তারাও মুখ্যমন্ত্রীর উপর হামলার পরিকল্পনায় অংশ নিতে পারে। |